বাঙালির খানাপিনা – বিরিয়ানির বারোমাস্যা
“বিরিয়ানি”- এটা এমন এক শব্দ যার আলাদা করে আর কোন পরিচয় লাগে না। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের আবেদন যে এখনও অটুট আছে, তাতো এর জনপ্রিয়তা দেখলেই বোঝা যায়। তুমি যদি আমারই মতন জিভে জল আনা এই বিরিয়ানির, একজন দারুন ভক্ত হয়ে থাকো তাহলে চলো জেনে নেই, প্রিয় এই খাবরটি কি করে ভারতবর্ষের সেরা একটি খাবারে পরিণত হল সেই গল্পটি।
বিরিয়ানি শব্দটি এলো যেভাবে:
এই শব্দটি এসেছে সেই সুদূর পারস্য থেকে । ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ আর ‘বিরিঞ্জ’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘বিরিয়ানি’র। ‘বিরিয়ান’ শব্দের অর্থ হলো ” রান্নার আগে ভেজে নেয়া” আর “বিরিঞ্জ” অর্থ হলো “চাল”।
বিরিয়ানি রান্নার আগে ঘি দিয়ে ভেজে নেয়া হয় সুগন্ধি চাল, আর সে কারণেই বিরিয়ানির এমন নামকরণ। মজার কথা হলো, আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলেই বিশেষত বৃহত্তর ময়মনসিংহের অঞ্চলে যে “বিরান করা” শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু এই ফারসি শব্দ থেকেই এসেছে।
বিরিয়ানির ইতিহাস
বিরিয়ানির জন্ম নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। তবে সব গল্পের মাঝে যে মিলটা দেখা যায় তা হলো, বিরিয়ানির উৎপত্তি হয়েছে এশিয়ার পশ্চিমাংশ থেকে। এইসব হাজারো গল্পের মাঝে তিনটি গল্পই সবচেয়ে বেশি ঐতিহ্যবাহী ও প্রচলিত।
ধারণা করা হয় তুর্কি মঙ্গল বিজয়ী তৈমুর ১৩৯৮ সালে বিরিয়ানি কে ভারতবর্ষের সীমানায় নিয়ে আসেন। শোনা যায় একটা বিশাল মাটির হাঁড়িতে চাল, মসলা মাখা মাংস, ঘি সব একসাথে পুরে ঢাকনাটা ভালো মতো লাগিয়ে দেয়া হতো। এরপর গনগনে গরম একটা গর্তে হাঁড়িটা কে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো সবকিছু সেদ্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। সেদ্ধ হয়ে গেলে হাঁড়ি টা বের করে নিয়েই তৈমুরের সেনাবাহিনীকে খাওয়ানো হতো সেই খাবার যাকে এখন পুরো বিশ্ব চেনে বিরিয়ানি নামে।
আর একটি প্রচলিত ধারণা হলো ভারতবর্ষে বিরিয়ানি এসেছে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। ভারতবর্ষে বিশেষ করে মালাবারের দক্ষিণ উপকূলে তুরস্ক ও আরব ব্যবসায়ীদের বেশ আনাগোনা ছিল। তাদের কাছ থেকেই নাকি বিরিয়ানির উৎপত্তি হয়েছে।
তবে এসব গল্পের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সমাদৃত হল মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মুহল এর গল্পটি। আমরা সবাই জানি সম্রাট শাহাজাহান এর তাজমহল তৈরীর অনুপ্রেরণা হলো, তার অনিন্দ্য সুন্দরি স্ত্রী মমতাজ মহল। কিন্তু তার আরো একটা পরিচয় আছে। ইতিহাস বলে ভারতবর্ষে বিরিয়ানির সূচনাটা নাকি তিনিই করেছিলেন।
জনশ্রুতি আছে যে, একদিন মমতাজ মহল সৈন্যদের ব্যারাকে যান তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। তবে সেখানে গিয়ে দেখেন, সৈন্যদের খুবই করুণ অবস্থা। তাদের ভগ্ন স্বাস্থ্য তাকে এতই ভাবিয়ে তুললো যে তিনি তৎক্ষনাৎ সৈন্যদের বাবুর্চি কে ডেকে আনলেন। আর নির্দেশ দিলেন চাল ও মাংস দিয়ে এমন একটা খাবার তৈরি করতে যা সৈন্যদের পুষ্টি দেবে ও স্বাস্থ্যও ফিরিয়ে আনবে। আর তারপর যে খাবার টা তৈরি করা হলো, সেটাই আজকের বিরিয়ানি নামে পরিচিত।
দারুন স্বাদের এই বিরিয়ানি এরপর খুব সহজেই চলে এলো মুঘলদের খাবারের পাতে। আর মুঘলরা ভারতের যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই বিরিয়ানি কে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর সেখান থেকেই একেক স্থানে বিরিয়ানি পেয়েছে একেক মাত্রা।
বিরিয়ানির বৈচিত্র্য
পুরো পৃথিবী তো দূরের কথা কেবল এই ভারতবর্ষেই যে কত প্রকার বিরিয়ানি আছে, তাই হয়তো গুনে শেষ করা যাবে না। তবে এর মাঝে ঢাকাই, হায়দ্রাবাদি, সিন্ধি, লখনৌই, বোম্বাই, থালেশ্বরী, কলকাতা, মালাবারি ইত্যাদি বিরিয়ানি উল্লেখযোগ্য।