শিকারা: যুগের চাহিদায় ম্লান কাশ্মীরের কাহিনী
কাশ্মীরকে লেখা এক প্রেমপত্র। নিজের পরিবারের জন্য। নিজের জন্মভূমির জন্য। ভালবাসার জন্য এ চিঠি। বিধু বিনোদ চোপড়ার ‘শিকারা’ সে বার্তা দিয়েই শেষ হয়েছে। হিংসা আজকাল ঢাকা হয়ে থাকে মিষ্টি কথার মোড়কে। সে ভাবনা উপেক্ষা করে এ ছবিটি দেখে সুখে থাকাও যেত, যদি অনুভূতিতে কিছু কাঁটাতার লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হত।
অথবা যদি কাশ্মীরের পরিস্থিতির ছবিটা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা দেখা যেত ‘শিকারা’য়। যদি সত্যের রাজনীতিকরণ না হত আবার করে। যদি না এ ভূখণ্ডের সব সমস্যার বিশ্লেষণে ব্যবহৃত সেই অতি পরিচিত, অতি সরল এক সমীকরণ আবারও ব্যবহার করা হত। ‘হিন্দু বনাম মুসলমানের’ রাজনীতিতে যদি না সহজে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত কাশ্মীরী পন্ডিত সমাজের ইতিহাসকে।
উপত্যকা ছেড়ে কাশ্মীরী পন্ডিতদের চলে যেতে হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখের। তাঁদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, বাড়ির মেয়েদের অসম্মানিত হওয়া, যত্রতত্র খুন-জখম-লুঠ— সবটাই অতি দুর্ভাগ্যের। এ অন্যায়। সে কথা এ ভাবে বলাও বাহুল্য। তবে এ সমস্যা হঠাৎ এক দিনের নয়। হঠাৎ একটি গোষ্ঠীরও নয়। এ সমস্যা কাশ্মীরের বৃহত্তর সঙ্কটেরই একটি অংশ। স্বাধীনতা পরবর্তী কাশ্মীরের এটা নিত্যদিনের চেহারা। এ সমস্যা সকল মানুষের। গোটা উপত্যকার। শুধু পন্ডিত বা শুধু কাশ্মীরী মুসলমানের নয়।
কাশ্মীরী পন্ডিত পরিবারের কলেজ শিক্ষক নায়ক সেই বৃহত্তর সমাজেরই এক জন। তাঁর স্বজন বিয়োগের দুঃখের সঙ্গে কোথাও ফারাক নেই সন্তানহারা হাজার হাজার মায়ের কান্না, ‘হাফ-উইডো’দের হাহাকারের। সে কথা কেন কোথাও ধরা দেয় না? যখন কোনও এলাকা বা সমাজ হিংসায় জ্বলে ওঠে, তখন সেখানকার মানুষ নানা ভাবে আক্রান্ত হন। সেখানে আসলে ধর্ম থাকে না। সে যন্ত্রণা ধর্মের রাজনীতির উর্ধ্বে। সে কথা বার বার যেন ভুলে গিয়েছে দেশভাগ চর্চা, রোহিঙ্গাদের সঙ্কট নিয়ে চর্চা, কাশ্মীর সমস্যা চর্চাও। এবং তেমনটাই আবারও হল। সময় বুঝেই যেন হল।
রাজনীতি বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে নানা ভাবে ব্যবহার করে। কাশ্মীরে তা বার বার হয়েছে। আরও অনেক বার হবে। তবে এত দিন পরে যখন কাশ্মীরী পন্ডিতদের নিয়ে বড় পর্দায় কথা উঠেছে, তখন বোধহয় এ ভূখণ্ডের ইতিহাসটা আর এক বার ভেবে দেখার সময় এসেছে।
অভিনয়ের দিক থেকে অবশ্যই অতি উন্নত নয় তাঁদের কাজ, তবে কখনও কখনও মন্দ লাগে না সাদিয়া আর আদিলের রসায়ন। প্রায় আশিটি ফ্রেমে তাঁদের দু’জনের একসঙ্গে উপস্থিতিই কি আসলে ছিল সেই ম্যাজিক বড়ি, যার মধ্যে দিয়ে কখন কান্নার ছলে নতুন করে হিংসা ঢুকে গেল মনে?
অবশ্যই কষ্ট করেছেন তাঁরা। রিফিউজি ক্যাম্পে কেটেছে বছর কুড়ি। রাহুল পন্ডিতা-র গল্প নিশ্চয় নাড়া দেয়। কাশ্মীর থেকে দেশের অন্য প্রান্তে আসার পরে শরণার্থীদের পরিস্থিতি, ক্যাম্পের জীবনঅবশ্যই দেখানো প্রয়োজন ছিল। কী ভাবে কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর, যা কি না কারও কারও ক্ষেত্রে অর্ধেক জীবন— দেখা দরকার। শুধু সব আখ্যান ধর্মের গেরোয় ফেঁসে না থেকে শিল্পের উপযোগী কিছু কাজ করতে পারত।
বিভিন্ন যুগেই তো ঋত্বিক ঘটকদের প্রয়োজন পড়ে। যাঁরা কি না দেখাবেন মানুষের জীবন, শুধু মানুষ হিসেবে। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়। সে খামতিটাই আসলে চোখে পড়ে বারবার রিফিউজি ক্যাম্পের জীবন, মুসলমান বন্ধুর আচরণ, বারবার রক্তপাত আর হাহাকারে।
(লেখনী: সুচন্দ্রা ঘটক। এই রিভিউটি প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়)