বাঙালির হেঁশেল থেকে হারিয়ে যাওয়া কিছু রান্না
মানুষের স্বভাবজাত জায়গা পরিবর্তন প্রক্রিয়া, উপকরণের অপ্রতুলতা, আয়োজনের জটিলতা, জনরুচির পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে অনেক খাবার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে বা অপ্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সেই খাবারগুলো কোনো না কোনোভাবে বেঁচে আছে আমাদের স্বাদস্মৃতিতে।
খাদ্যসংস্কৃতির জগতে হারিয়ে যাওয়া খাবারের তালিকা নেহাত ছোট নয়। হারিয়ে যাওয়া খাবারগুলোর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক সংস্কার, অনুষ্ঠান, অভ্যাস, অনেক গল্প কিংবা স্মৃতি। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে খাবার সুস্বাদু করার সূক্ষ্ম লোকায়ত জ্ঞান।
এই নাগরিক জীবনের বিপুল ব্যস্ত সময়ে হঠাৎ রেলিংয়ে বসা চড়ুই দেখে আমরা যেমন ফিরে যাই শৈশব-কৈশোরের ধূসর জগতে, তেমনি কখনো কখনো হঠাৎ মনে হয়, আহা, কত দিন ওই খাবারটা খাওয়া হয় না! আটপৌরে হেঁশেল তখন হয়ে ওঠে স্মৃতি হাতড়ানোর জাদুর বাক্স। খোঁজ পড়ে সেই খাবারের রন্ধনপ্রণালির, সেই রাঁধুনির।
আমরা চেষ্টা করেছি কিছু হারিয়ে যাওয়া বা অপ্রচলিত হয়ে যাওয়া খাবারের রন্ধনপ্রণালি খুঁজে বের করার। দেখে নিন:
পুঁটি মাছের শুঁটকিতে ঝাল কচুশাক
উপকরণ: ডাঁটাসহ কচুশাক আধা কেজি, পুঁটি মাছের শুঁটকি ১ কাপ, থেঁতো করে নেওয়া রসুন আধা কাপ, কাঁচা মরিচ ১০/১২টি, পাঁচফোড়ন আধা চা-চামচ, জিরাবাটা ১ টেবিল চামচ, সয়াবিন তেল ২ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, ভেজে নেওয়া শুকনো মরিচ ২টি।
প্রণালি: কচুশাক ধুয়ে বেছে ডাঁটাগুলো দেড় ইঞ্চি লম্বা করে এবং শাকগুলো মাঝখানে কেটে নিন। পুঁটি মাছের শুঁটকির পেট পরিষ্কার করে ভালো করে গরম জলে ধুয়ে নিন। এবার কড়াইয়ে তেল গরম করে পাঁচফোড়ন ও থেঁতো করা রসুনের কোয়াগুলো এবং শুঁটকিগুলো একসঙ্গে ভালো করে ভেজে নিন। ভাজা হয়ে এলে তাতে মাঝখানে চিরে নেওয়া কাঁচা মরিচ দিয়ে কচুশাক দিয়ে একটু নেড়ে নিন। আগুনের আঁচে শাক কমে এলে লবণ দিয়ে অল্প পরিমাণ জল দিয়ে ঢেকে দিন এবং চুলার জ্বাল মাঝারি আঁচে রাখুন। শাকের জল বের হয়ে শাক সেদ্ধ হয়ে এলে জিরাবাটা দিয়ে মিনিট পাঁচেক কষান। কষাতে কষাতে শাক গলে জল টেনে প্রায় শুকনো হয়ে এলে নামিয়ে ফেলুন। নামানোর আগে দুটো ভাজা শুকনো মরিচ শাকের ওপর দিয়ে দিন।
রেসিপি: দেবদ্যুতি রায়
শজনে দিয়ে ছোলার ডাল
উপকরণ: ছোলার ডাল ২ কাপ, শজনে ৪টি, ঘি ২ টেবিল চামচ, দারুচিনি ৩/৪ টুকরো, সাদা এলাচি ৩/৪টি, লবণ পরিমাণমতো, হলুদ আধা চা-চামচ, তেজপাতা ৩টি এবং পাঁচফোড়ন পরিমাণমতো।
প্রণালি: ছোলার ডাল ধুয়ে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। এরপর পরিমাণমতো পানি দিয়ে ডাল সেদ্ধ করে নিন। পানির পরিমাণ এমন রাখুন যেন ডাল সেদ্ধ হওয়ার পরও দুই কাপ আন্দাজে পানি থেকে যায়। ডাল সেদ্ধ করার সময় লবণ আর হলুদ দিয়ে দিন। শজনে তিন ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা করে কেটে নিয়ে কড়াইয়ে তেল গরম করে লবণ, হলুদ দিয়ে শজনেগুলোকে হালকা করে ভেজে নিন। এবার আরেকটি কড়াইয়ে ঘি গরম করে তাতে তেজপাতা, পাঁচফোড়ন ও শুকনো মরিচের ফোড়নে সেদ্ধ করে রাখা ডাল বাগাড় দিন। বাগাড় দেওয়া ডালে শজনেগুলো দিয়ে দারুচিনি আর সাদা এলাচি দিন। ডাল ফুটে উঠলে দুই মিনিট পর নামিয়ে পরিবেশন করুন।
রুই মাছের মাথা দিয়ে কলার মোচা
উপকরণ: কলার মোচা ১টি, মাঝারি আকারের আলু ২টি, ছোট টুকরো করে কেটে নেওয়া রুই মাছের মাথা ১টি, লবণ স্বাদমতো, সয়াবিন তেল ৪ টেবিল চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচ, জিরাবাটা ১ টেবিল চামচ, দারুচিনি ৩/৪ টুকরো, পাঁচফোড়ন আধা চা-চামচ, পেঁয়াজকুচি আধা কাপ, রসুন থেঁতো করা ৪/৫ কোয়া, কাঁচা মরিচ ৫/৬টি, শুকনো মরিচ ২টি, তেজপাতা ৩টি।
প্রণালি: কলার মোচা ভালো করে ছাড়িয়ে ভেতরের সাদা কেশর বাদ দিয়ে কুচিয়ে নিন। আলু ছোট ছোট চৌকো আকারে কেটে নিন। মাছের মাথা ধুয়ে বেছে লবণ, হলুদ মাখিয়ে নিন। এবার কড়াইয়ে তেল গরম করে মাছের মাথাগুলো কড়া করে ভেজে নিন। সেই তেলে পাঁচফোড়ন, মাঝখানে চিরে দেওয়া তেজপাতা দিয়ে পেঁয়াজকুচি আর থেঁতো করে রাখা রসুনের কোয়াগুলো দিয়ে একটু ভেজে নিন। পেঁয়াজ, রসুন ভাজা ভাজা হয়ে এলে শুকনো মরিচ ফোড়ন দিয়ে তাতে আলু দিয়ে দিন।
লবণ, হলুদ, কাঁচা মরিচ ফালি দিয়ে আলু অল্প করে কষিয়ে কুচোনো কলার মোচা দিয়ে দিন। এক কাপ জল দিয়ে চুলার আঁচ মাঝারি মাত্রায় রেখে ফ্রাই প্যান বা কড়াই ঢেকে দিন। জল শুকিয়ে এলে ভেজে রাখা মাছের মাথা দিয়ে মিনিট দশেক কষিয়ে নিন। কষানোর সময় অল্প অল্প করে জল দিতে হবে। এরপর জিরাবাটা আর গোটা দারুচিনি দিয়ে মাখা মাখা করে নামিয়ে নিয়ে ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
রেসিপি: দেবদ্যুতি রায়
কই মাছের গঙ্গা যমুনা
উপকরণ: ৪ টি মাঝারি সাইজের কই মাছ, ২ টেবিল চামচ সাদা সর্ষে (গোটা), ১ চা চামচ কালো সর্ষে (গোটা), ১ চা চামচ কালোজিরে (গোটা), ১.৫ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো, ১.৫চা চামচ কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো, ৫ টি গোটা কাঁচা লঙ্কা, ২০ গ্রাম তেঁতুল, ৯ টেবিল চামচ সর্ষের তেল, ২ চা চামচ চিনি, স্বাদমত নুন
প্রণালি: কই মাছ নুন ও হাফ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো মাখিয়ে রাখতে হবে। সাদা সর্ষে এক চিমটে নুন ও একটি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বেটে নিতে হবে। তেঁতুল কিছুক্ষন জলে ভিজিয়ে রেখে তারপর হাত দিয়ে চেপে পাল্প করে নিতে হবে। ৬ টেবিল চামচ সর্ষের তেল গরম করে কই মাছ গুলি খুব হালকা ভেজে তুলে নিতে হবে।
তারপর ওই তেলেই কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে সাদা সর্ষে বাটা, বাকি ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো, ১ চা চামচ কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো, ২ টি গোটা কাঁচা লঙ্কা ও নুন দিয়ে একটু কষিয়ে নিয়ে তারপর এক কাপ জল দিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে একটু ফুটিয়ে নিতে হবে। এটা তৈরী হলো গঙ্গা গ্রেভি। গ্রেভি বেশ ঘন হয়ে এলে ভেজে রাখা মাছ গুলি গ্রেভিতে দিয়ে ২-৩ মিনিট মাঝারি আঁচে রেখে নামিয়ে নিতে হবে। মাছ গুলি ওল্টানো যাবেনা, মাছের শুধু এক পিঠে এই সর্ষের গ্রেভি বা গঙ্গা গ্রেভি মাখানো থাকবে।
এবার আরো ২ টেবিল চামচ সর্ষের তেল গরম করে কালো সর্ষে ফোড়ন দিয়ে তারপর তেঁতুলের পাল্প, বাকি হাফ চা চামচ কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো, বাকি ২ টি গোটা কাঁচা লঙ্কা, চিনি ও নুন দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে হাফ কাপ জল দিতে হবে। এটা তৈরী হলো যমুনা গ্রেভি।
মাঝারি আঁচে রেখে ফুটিয়ে নিয়ে গ্রেভি ঘন হয়ে এলে এক পিঠে সর্ষের গ্রেভি মাখানো মাছ গুলি উল্টো পিঠ করে এই গ্রেভিতে দিতে হবে। মাছের উপরের পিঠে থাকবে সর্ষের গ্রেভি (গঙ্গা) ও ওপর পিঠে থাকবে তেঁতুলের গ্রেভি (যমুনা)।
২-৩ মিনিট মাঝারি আঁচে রেখে ওপর থেকে বাকি এক টেবিল চামচ সর্ষের তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে কই মাছের গঙ্গা-যমুনা। গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করতে হবে।