প্রতিবাদ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই, বলছেন বাংলার শিল্পীরা
দিল্লি জ্বলছে। আর তার আঁচ এসে লাগছে সারা দেশে। পরিস্থিতি জটিল হলেও, প্রতিবাদ থামেনি। আক্রান্তরা সরাসরি রাস্তায় নামছেন। ছাত্র, নাগরিক ও শিল্পী সমাজ প্রতিবাদ করছে মাঠে-ময়দানে। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছে টুইটে। এ দুর্দিনে শিল্পীর স্বাধীনতা কোন জায়গায়? প্রতিবাদে তাঁদের ভূমিকাই বা কী?
ক্রমাগত প্রতিবাদ ছাড়া আপাতত আর কোনও রাস্তা দেখছেন না বাংলার অভিনেতা-পরিচালক-গায়ক-নাট্যশিল্পীরা। দিল্লির ঘটনার নিন্দা করে ব্যঙ্গাত্মক টুইট করেছিলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। যাতে তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘নিজে যেটা ভাল পারেন, সেটাই করুন মন দিয়ে। কেন এ সবে জড়াচ্ছেন?’ এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তেজিতই শোনাল তাঁকে, ‘‘আমরা যাঁদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি, আসল কাজটা তো তাঁদের করার কথা। আমরা টুইট ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি! দিল্লির ঘটনা দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম কালো একটা দিন।’’
সঙ্গীতশিল্পী সিধু বললেন, ‘‘এখন ক্রমাগত বিরোধী কণ্ঠরোধের চেষ্টাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন শিল্পী হিসেবে আমি গানের মাধ্যমেও প্রতিবাদ করতে পারি, আবার নাগরিক হিসেবে মিছিলেও হাঁটতে পারি। জোর করে এ ভাবে কোনও আইন প্রণয়ন করা যায় কি? বিশেষ করে তার পরিণতি যদি এমন ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যায়?’’
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়িকা ইমন বললেন, ‘‘কোনও শিল্পীর উপরে যদি রাজনৈতিক চাপ আসে, তা হলে তাঁদের ঠিক করতে হবে নিজেদের অবস্থান। কঙ্গনা রানাউত কিংবা অক্ষয়কুমার যখন পরপর ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেলেন, তাঁদের সুর পাল্টে যেতে দেখেছি আমরা। যদিও তাঁরা অসম্ভব গুণী শিল্পী।’’ সোমবারে দিল্লির চিত্র কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলেই মনে করেন ইমন, ‘‘এত অসহিষ্ণুতার কারণ কি প্রাথমিক অপ্রাপ্তিই? বিবেকানন্দকে যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁদের কিছু এসে যায় না ট্রাম্প তাঁর নাম উচ্চারণ করতে পারলেন কি না।’’
যা ঘটছে, তাতে অর্ধ শতক পরে ইতিহাস আমাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে বলে মনে করছেন অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। মঙ্গলবার একটি মসজিদে আক্রমণের ভিডিয়ো রিটুইট করে পরিচালক রাজ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘এ ভাবে লড়তে থাকলে একদিন আর মানুষ থাকবে না, শুধু মন্দির-মসজিদই থাকবে।’ আগামী ছবি ‘ধর্মযুদ্ধ’য় রাজনৈতিক হিংসার ঊর্ধ্বে উঠে সম্প্রীতির বার্তা দিতে চাইছেন তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে শিল্পমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দিহান অনির্বাণ, ‘‘পরিস্থিতি যে জায়গায় চলে গিয়েছে, তাতে পোশাকি প্রতিবাদে আর কাজ হবে না। আমরা নিজেদের শিল্প-সিনেমা-সংস্কৃতির জায়গাটাও তো অত্যন্ত ফাঁপা করে ফেলেছি।’’
আর এক তরুণ পরিচালক সৌকর্য ঘোষালের কথায়, ‘‘আমার যে রাজনৈতিক বিশ্বাস, তাকে একশো শতাংশ ফুটিয়ে তুলে কোনও ছবি এ দেশে রিলিজ় করতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি না। সত্যজিৎ রায়কে এক বার প্রশ্ন করা হয়েছিল, মৃণাল সেন তো এত রাজনৈতিক ছবি করেন, আপনি করেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃণাল অনেক সফ্ট টার্গেট। আমি যে রকম পলিটিক্যাল ছবি বানাতে চাই, ও রকম বানালে আমি থাকতে পারব না।’ আমার সিনেমাকে সেন্সর আটকাতে পারে কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তো সংবিধানের দেওয়া। সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’’
প্রতিবাদ ঠিক নিজের ভাষা খুঁজে নিচ্ছে। যে যার পরিসরে বিরোধিতা করছেন হিংসা, বিভেদের রাজনীতির। আশার কথা সেটাই।
এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকাতে।