‘ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেই উঠে আসবে উদয়ন পণ্ডিত’
গণতন্ত্র, শিল্প ও প্রতিবাদ নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
কখনও ব্যোমকেশ, কখনও ফেলুদা। তোপসে আবার অনিমেষ। অভিনেতা থেকে পরিচালক – নানা ভূমিকায় পেয়েছি নানা সময়ে। বাংলার অন্যতম পরিচিত প্রতিবাদী মুখ।
কোরাস ২০২০ এর আগে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মুখোমুখি হলেন টিম দৃষ্টিভঙ্গির।
রাজনীতি থেকে সিনেমা, প্রতিবাদ থেকে শিল্প – খোলামেলা উত্তর দিলেন সব বিষয়ের।
প্রঃ আপনি বরাবরই এক প্রতিবাদের মুখ। ডাক্তারদের অনশন মঞ্চ থেকে সি এ এ-এর প্রতিবাদের প্রথম সারিতে আপনাকে দেখা যাচ্ছে। কোরাসের মঞ্চে আপনার কাছ থেকে কি পেতে চলেছি?
পরমব্রত: প্রথমে বলি আমি প্রতিবাদের মুখ টুক বললে অনেকটা দায়িত্ব ঘাড়ে চলে আসে। সত্যি বলতে কি যতটা চাই প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে সেটা সবসময় যে করা হয়ে ওঠে সেটা নয়। সেই কারণে এই কথাগুলো শুনলে একটু অত্যুক্তি করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
আরও হয়ত অনেক জরুরী কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। সব সময় সেটা বলতে পারিনা। আমরা প্রত্যেকেরই কিছু ভয় পাই আমরা। এবং ভয়টা মানুষ মাত্রই পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আমার মনে হয় এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়েছি যখন নিজেদের পেশার চিন্তা, স্বার্থের চিন্তা, আমাদের নিরাপত্তার চিন্তা, এগুলো ভীষণ জরুরী, যেগুলি মানুষ মাত্রই থাকে। প্রত্যেকটা মানুষই চায়।
সেগুলি ছাড়িয়ে কোথায় একটা এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে আর থাকা যাচ্ছে না। এই চিন্তাগুলো করতে করতে কোথাও একটা যেন মনে হচ্ছে তার পাশাপাশি কোথাও একটা বড় দায়িত্ব বর্তাচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে এবং সেই জায়গা থেকে কোরাসে অংশগ্রহণ করা বা কোরাসের ভাবনাটা আমাদের সকলের মাথায় আসা। এবং সেই ভাবনাটারই একটা এক্সটেনশন, সেই ভাবনাটারই একটা আর্টিস্টিক ম্যানিফেস্টেশন আমরা দেখব কোরাস-২০২০ এর মঞ্চে।
প্রঃ- আপনি ঋত্বিক ঘটকের সম্পর্কিত। ওনার ছবিতে আমরা দেখেছি রিফুইজি ক্রাইসিস বারবার উঠে এসেছে। এমনকি সিএএ-র সমর্থনে বিজেপি ওনার ছবির ক্লিপও ব্যবহার করেছে। আপনার কি মনে হয় না ঋত্বিক ঘটক আজ ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক? আর, ওনার ছবিতে ভিটেছাড়া হওয়ার যে যন্ত্রনা সেই বার্তাটা মানুষের কাছে কিভাবে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে?
পরমব্রত: ঋত্বিক ঘটকের ছবি আজকে এই সিএএ -র পরবর্তী সময়েতে শুধু প্রাসঙ্গিক বলি তাহলে ঋত্বিক ঘটকের ছবিকে বিজেপি যেভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে সেই দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়। সেটা খুব বড় একটা ভুল, অন্যায় বা অবিচার হবে তার ছবি এবং জীবনবোধের প্রতি বলে আমার মনে হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ প্রথমে দুটি এবং পরবর্তীতে তিনটি। দেশের ভাগ হওয়াটা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। শুধু ভারতবর্ষের কথা বলছি না আমি। সারা পৃথিবীর কথা বলছি, যে কালো অধ্যায়গুলো আছে তার মধ্যে একটা অন্যতম হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে টু নেশন থিওরির উপর বেস করে ভাগ হয়ে যাওয়া, সেইটা অনস্বীকার্য। এটা এক কালো অধ্যায়, অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক একটা ঘটনা।
কিন্তু এই ধরণের একটা ঘটনার জন্যে সব ধর্মের লোক, সব জাতির লোক, সব রাজনীতির লোকে একধরণের দুঃখের মধ্যে দিয়ে যান কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান, যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যান এবং সব ধর্মের লোক, সব জাতির লোক, সব রাজনীতির লোকেদেরই কিন্তু একই রকম দায়িত্ব থাকে। একটাকে একদিক থেকে শুধু দেখলে যেটা হয়ত সম্প্রীতি কিছু হয়ত করার চেষ্টা হয়েছে এটা একটা ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে বড় ভাবে। মনুষ্যত্বের প্রতি অবিচার করা হয় যে দৃষ্টিভঙ্গিটা আর যার থাকুক ঋত্বিক ঘটকে ছিল না।, তাকতে পারে না।
এই কথাটা পরিবারের লোক বলে নয় এটা তাঁর সিনেমা দেখে, পরতে পরতে বোঝা যায় কথাটা। এটা অনস্বীকার্য।
প্রঃ সাধারণ মানুষের কি দেশের গণতন্রের ওপর আস্থা কমে আসছে? আমাদের কি তবে এক দশক আগেকার মিশরের মত গণ অভ্যুত্থান দরকার?
পরমব্রত: ইজিপ্টের মতো গণঅভ্যুত্থান দরকার কিনা এটা বলার হয়ত যোগ্যতা আমার নেই। তবে একটা কথা বলতে পারি যে যদিও আমাদের দেশে বৃহত্তর গণতন্ত্র তথাকথিতভাবে। গণতন্ত্রের জন্য যে পরিবেশটা লাগে সেই পরিবেশটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিরাট বড় ধাক্কা খেয়েছে। যার ফলে সারা পৃথিবীতে আলোচনা হচ্ছে যে সারা পৃথিবীর সবথেকে বড় যে গণতন্ত্র তারা কি করে এই ডামাডোলের মধ্যে গিয়ে পড়ল?
এখানে তাদের ভাবতে হবে এই যে ভারতবর্ষ একটা ৭০ বছর হল স্বাধীন দেশ। ঐ সময় যে দেশগুলি স্বাধীন হয়েছিল পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে – আফ্রিকাতে, এমনকি সাদার্ন ইউরোপে, এশিয়ার কিছু কিছু প্রান্তে – সবকটি দেশে পরবর্তীকালে আমরা আর্মি কূ দেখেছি। মিলিটারি কূ দেখেছি। ভারতবর্ষে কিন্তু আমরা দেখিনি। অনেক কষ্টেশিষ্টে অনেক অভিযোগ অনেক অনুযোগ, অনেক ঝামেলা পুইয়ে কিন্তু কোথাও একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ টিঁকিয়ে রাখা হয়েছিল। টিঁকে গেছিল। ক্রমে বিষিয়ে যেভাবে পোলারাইজ করা হচ্ছে মানুষকে অন্য জিনিসের দ্বারা তার ফলে ডেফিনেটলি আমাদের দেশের গণতন্ত্র একটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। মানুষ গণতন্ত্রে আস্থা হারিয়েছে কিনা সেটা বলার সময় এখন আসেনি। এটাই আমার বিশ্বাস।
প্রঃ আপনি একটা টুইট করেছিলেন যে হীরক রাজার দেশে এবার উদয়ন পণ্ডিতের দরকার। আপনার কি মনে হয়, উদয়ন পণ্ডিত হওয়ার যোগ্যতা কার আছে বর্তমানে?
পরমব্রত: নিশ্চয়ই আছে। আমার মনে হয় একজন কেউ উদয়ন পন্ডিত হলে তো হবে না। হীরক রাজার দেশ একটা ছোট্ট জায়গা, একটা ছোট্ট পরিসরে একটা ছোট্ট গ্রামের, একটা ছোট্ট রাজ্যের মধ্য দিয়ে বলা একটা রূপক। সেটা সারা দেশের রূপক, সারা পৃথিবীর রূপকও বটে। তো উদয়ন পন্ডিত তো সারা পৃথিবীর, সারা দেশের। শিক্ষা এবং শান্তির বার্তা দিতে গেলে তো একটা উদয়ন পন্ডিত হলে হবে না। হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ লোক লাগবে। সারা দেশে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তাদের ক্লাস ছেড়ে দিয়ে, হয়ত বা তাদের কেরিয়ার বাজি রেখে দিয়ে, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে গত তিন মাস ধরে। আমার বিশ্বাস, তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রচুর উদয়ন পণ্ডিত।
প্রঃ দেশের বর্তমান যা পরিস্থিতি, তাতে শিল্প, গান, কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টি করা কতটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে?
পরমব্রতঃ দেখুন এর দুটো দিক হয়। শিল্প সৃষ্টি – গান, কবিতা বা সিনেমা যা হোক – কেউ একজন ছন্দ মিলিয়ে লিখলে টেকনিক্যালি সেটা কবিতা হয়। কেউ সুরে গান গাইলে টেকনিক্যালি সেটা গান হয়। কেউ সুন্দর করে চলচ্চিত্র বানালে – সুন্দর অভিনয়, ঠিকঠাকভাবে বানানো, সুন্দর করে গল্পটা বলতে পারলে সেটা টেকনিক্যালি চলচ্চিত্র হয় বলে আমরা ধরে নিই। কাজেই সেই দিক থেকে শিল্প কোনদিনই কঠিন ছিল না, এমনকি নাৎসি জার্মানিতেও নয়।
লেনি রিফেনস্টাল হিটলারের সবথেকে বড় এড, সবথেকে বড় সহায়িকা উনি হিটলারকে নিয়েও ছবি বানাতেন, দেখতে খুব সুন্দর হত, খুব সুন্দর করে শ্যুট করা হত। তাই একদিক থেকে দেখতে গেলে সেটাও এক অর্থে শিল্প। শিল্পের একটা দায় থাকে সত্যের প্রতি, সমাজের প্রতি, মনুষ্যত্বের প্রতি। তবেই শিল্প, ‘শিল্প’ হয়ে ওঠে। শিল্প শুধুই টেকনিক্যাল ব্রিলিয়ান্স নয়। শিল্প হল আমাদের ছোট অস্তিত্ব পেরিয়ে গিয়ে আরও বৃহৎভাবে, আরও ঐতিহাসিকভাবে ঠিক দিকটা নির্বাচন করা। মনুষ্যত্বের দিকটাও নির্বাচন করা হল শিল্প। তাই সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, হ্যাঁ, শিল্প সৃষ্টি কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রঃ আপনার অনেক সতীর্থ রাজনৈতিক দলে আছেন। এর ফলে কি ব্যক্তিগত সম্পর্কে টান পড়ে?
পরমব্রতঃ দেখুন, আমার কাছে রাজনীতি বিষয়টি খুব সরল। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন দলের রাজনীতি করি না আর কোনদিন করবও না। তবে আমার মনে হয় কিছু ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করা যায় না। আমার মনে হয়, যারা এই মুহূর্তে এই চূড়ান্ত মনুষ্যত্ব বিরোধী, চূড়ান্তভাবে নাৎসি, চূড়ান্তভাবে পোলারাইজিং, বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতি করছে আমার কাছে তারা একদিকে, বাকি সব রাজনীতিকরা আর এক দিকে।
এমন নয়, বাকি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবাই ধোয়া তুলসী পাতা – একদমই তা নয়। তাদেরও নিজেদের প্রত্যেকের প্রচুর সমস্যা রয়েছে, তাদেরও যথেষ্ট আত্মপরিশোধন দরকার, প্রত্যেকটি দলেরই। কিন্তু কোথাও একটা আমার মনে হয় যে, সময়ের খাতিরে, ইতিহাসের খাতিরে যে কোর রাজনীতির বিরোধী আমি বা আমরা সেই রাজনীতিটা একদিকে আর বাকি সব রাজনৈতিক দল, আর একদিকে ওই বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতি।
ওই অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতি যারা করছে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে টান পড়ে, যারা করতে গেছেন ওই ধরনের রাজনীতি তাদের সঙ্গে আগে বিরাট ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, এখন খুব টানাপোড়েনে পড়েছে এমনটা নয়। তবে হ্যাঁ, কিছু মানুষ নিশ্চয়ই আছেন যারা সরাসরি সেই রাজনীতি না করলেও তাকে সমর্থন করছেন, তাদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত সম্পর্ক হালকা হলেও টান পড়েছে, কিন্তু আমার তাতে কোন আক্ষেপ নেই, কোন মন খারাপও নেই।
কেননা আমার মনে হয় বন্ধুত্ব তখনই সম্ভব যখন কোথাও আমরা একে অন্যেকর সঙ্গে বেসিক একটা জায়গা থেকে connect করতে পারি। আর যারা ওই অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখছেন তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন যোগাযোগ হয় না। যেহেতু যোগাযোগ হয় না, তাই তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব আগেও ছিল না, আর এখনও তারা ওই রাজনীতি করছেন বলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিরাট টান পড়েছে এমনটাও না। তবে দু-একজন আছে, যাদের সঙ্গে আগে অনেক দেখা হত বা কথা হত কিন্তু এখন একটু কম হয়।
প্রঃ সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে আপনাকে কখনোও কোনদিন দেখতে পাওয়া যাবে না?
পরমব্রতঃ আমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি সেটা যথেষ্ট সক্রিয়। এই যে আমি কথাগুলো বলছি এটা ভীষণ সক্রিয় একটা পদক্ষেপ। আমার অধিকাংশ কর্মীরা, কয়েকজন বাদ দিয়ে, এতটা সক্রিয়ভাবে কেউ ভাবেনই না। যেহেতু আমাদের গণতান্ত্রিক দেশ, তাই আমাদের দেশে আমরা সক্রিয় রাজনীতি বলতে একটা পার্টির ট্যাগ বুঝি। পার্টির ট্যাগটাই কিন্তু সক্রিয়তার একমাত্র নিশান নয়। আমার সক্রিয়তা আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে আসে, সেটা একদম ঠিক জায়গায় আছে এবং আমি যথেষ্ট সরবও। সক্রিয়তার জন্য আমার কোন দলের ট্যাগ এর প্রয়োজন নেই।