নির্জনতাকে সঙ্গী করে ইতিহাসের গোপন কথা বলতে ডাকছে বড়ডাঙা
পূর্ব বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ডের দক্ষিণে বড়ডাঙার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। চৈতন্য সাধক নরহরি সরকারের তিরোধান তিথিতে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তার ঐতিহ্য সুদূরপ্রসারী।
বর্তমানের বড়ডাঙায় তৎকালীন সময়ে নিভৃত এক অরণ্য ছিল। সেখানেই নরহরি সরকার রচনা করেছিলেন ‘কৃষ্ণসাধনার বিলাসকুঞ্জ’। অনন্তসংহিতায় উল্লেখ আছে ‘বৃন্দাদেবী প্রাণসখী শ্রীমুকুন্দ কলৌযুগে।’ এই কারণে বড়ডাঙাকে দ্বিতীয় বা গুপ্তবৃন্দাবন বলা হয়। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নরহরি সরকারের জীবনাবসান হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে। কিন্তু ভক্তিরত্নাকরে অগ্রহায়ণ মাস উল্লিখিত আছে।
কথিত আছে, মোগল-পাঠানের যুদ্ধের সময় মোগলরা একসময় শ্রীখণ্ড আক্রমণ করেছিল। উদ্ধত মোগল সৈন্যরা কবির বাটি লুট করে রসিকরায় বিগ্রহকে অপহরণ করতে গেলে কবি প্রবল বাধা দেন। মোগল সৈন্যরা কবির শিরশ্ছেদ করে।
গৌরগুণানন্দ ঠাকুর শ্রীখণ্ডের ‘প্রাচীন বৈষ্ণবসমাজ’ গ্রন্থে বলেছেন, নরহরি সরকারের কাটা মাথা হরি নাম উচ্চারণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে। ঠাকুর রঘুনন্দন ও শ্রীনিবাস আচার্যের নেতৃত্বে প্রথম বাৎসরিক মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে। আজও সেই ধারা বহমান।
প্রত্যেক বছর গৌরবিগ্রহ-সহ গোপীনাথকে বড়ডাঙার মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। আগের দিন চব্বিশ প্রহরের অধিবাস কীর্তন শুরু। পরের দিন নামযজ্ঞের সূচনা এবং গৌরগোপীনাথের বড়ডাঙার মন্দির উদ্দেশে শোভাযাত্রা। একাদশী তিথিতে গৌরগোপীনাথের উদ্দেশে মালসাভোগ, মধ্যাহ্নে একাদশী অনুকল্পত্যাদি। পরের দিন পালিত হয় অন্ন-মহোৎসব। কুঞ্জভঙ্গ গান শেষে গৌরগোপীনাথের পুনরায় শ্রীখণ্ডের মন্দিরে প্রত্যাবর্তন ঘটে।
এই উপলক্ষে বড়ডাঙায় একসপ্তাহ ধরে মেলা বসে। বিভিন্ন বৈষ্ণবসাধক ও অগণিত সাধারণ মানুষের আগমন ঘটে। যাত্রা, কবিগান, লোকসংস্কৃতির আসর বসে। মেলায় হিন্দু—মুসলমান উভয় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ কীর্তন গান। এছাড়া মেলার আরেকটি আকর্ষণ হল সাদা ল্যাংচা। আকারে ল্যাংচা, স্বাদে রসগোল্লার ন্যায় এই মিষ্টি কয়েক ফুট লম্বা, দাম ২০০-৫০০ টাকা।
এ তো গেল সর্বজনবিদিত উৎসবের কথা। কিন্তু যাঁরা নির্জনতাকে সঙ্গী করে খুঁজে বেড়ায় অযত্নে লালিত মণিমানিক্য, তাঁদেরকে বলব অন্য কোনও সময় এই জায়গায় আসতে। কাটোয়া থেকে স্কুটিতে সুদপুর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তবে শ্রীখণ্ড হয়ে কিংবা বর্ধমান কাটোয়া ভায়া করুই কৈথন রুটের বাসেও আসা সম্ভব।