১৩ বি কর্নওয়ালিস স্ট্রিট – বাংলার এক বর্ণময় ইতিহাস
ভারতবর্ষের প্রথম প্র্যাক্টিসিং মহিলা ডাক্তার ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। কলেজ স্ট্রীটে ১৩বি কর্নওয়ালিস স্ট্রীট – এই বাড়িটিতে থাকতেন তিনি। বাড়িটি আজও সেখানে বর্তমান। কিন্তু চারিদিকে তার বয়সের ছাপ। শঙ্কর ঘোষ লেনের পাশেই এই বাড়ি। এই বাড়িটি ইতিহাসের এক বর্ণময় চরিত্র।
১৮৬১ সালে এই বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমী। ১৮৯০ সালে ক্যালকাটা অ্যাকাডেমী অন্যত্র চলে গেলে এই বাড়িতেই গড়ে ওঠে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়। পরে তা মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।
কলকাতায় তখন জোড় কদমে চলছে ব্রাহ্ম আন্দোলন। আন্দোলনের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই বাড়ি। ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় কাদম্বিনীকে বিয়ের পর এই বাড়িতে আসেন। এই দ্বারকানাথ বন্দোপাধ্যায়ের জামাই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল মুখ উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরি। উপেন্দ্রকিশোর, দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের মেয়ে বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। কাদম্বিনী ছিলেন দ্বারকানাথের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।
দ্বারকানাথ ১৩ বি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই বাড়িতে ওঠার পর উপেন্দ্রকিশোরও স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়িতে চলে আসেন। উপেন্দ্রকিশোরও ছিলেন ব্রাহ্ম। কার্যতই এই বাড়িটি ধীরে ধীরে ব্রাহ্ম আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল। সেই সময় অনেক সনাতনী হিন্দুরাই তাদের নিজেদের ব্রাহ্ম সন্তানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের সবার আশ্রয় হত এই বাড়িতে। এটিকে বাড়ি কম ব্যারাক বেশি বলা চলে।
এমন সময় এই বাড়িতে হাজির হলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক পন্ডিত রাম কুমার ভট্টাচার্য্য বিদ্যারত্ন। এই রামকুমার বিখ্যাত কুলি কাহিনীর লেখক। ইনিই মাইকেল মধুসূদনকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন। মধুসূদনের লিভারের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হলে রামকুমার তাকে বলেন, মদটা ছেড়ে দাও। মাইকেল বললেন, পন্ডিত আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু তুমি আমাকে মদ ছাড়তে বলো না। দরকারে তোমায় ছেড়ে দেবো। কিন্তু মদ ছাড়বোনা।
রামকুমারের সাথে বিয়ে হয়েছিল উত্তরপাড়ার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক অচলানন্দ পরমহংসের মেয়ে জ্ঞানদা দেবীর সাথে। রামকুমার ব্রাহ্ম হওয়ায় অচলানন্দ তাঁর মেয়েকে স্বামীর ঘরে যেতে দিতেন না। একদিন অচলানন্দের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রামকুমার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে আসে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই বাড়িতে।
রামকুমারের তিন মেয়ে বড় হয়ে গেলে তিনি সন্ন্যাস নেন। মেজো মেয়েকে মানুষ করার জন্যে উপেন্দ্র কিশোরের হাতে তুলে দিয়ে যান। মেজো মেয়ের নাম সুরমা। পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর প্রমোদরঞ্জনের সাথে সুরমার বিয়ে দেন। এই প্রমোদরঞ্জন এবং সুরমার মেয়ে বাংলা সাহিত্যের আরেক কাণ্ডারি শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার।
(তথ্যসূত্র: সুমিত চৌধুরী)