বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

জালিয়ানওয়ালাবাগ ও রবীন্দ্রনাথের একাকী প্রতিবাদ

April 13, 2020 | 3 min read

ইংরেজদের সুবিধা করে দিতে জনতার ওপর অত্যাচার ও ভয়ানক নির্মমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে ১৯১৯ সালের ১০ মার্চ বলবৎ করা হয় কুখ্যাত ‘রাওলাট অ্যাক্ট’। এমনই এক সময়ে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল ডাকা হলো এক প্রতিবাদসভা। স্থান নগরীর বিরাট জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যান। সেদিন আবার ছিল পাঞ্জাবের অন্যতম বৃহৎ উৎসব বৈশাখীরও দিন। 

আইনের ছলাকলা দেখিয়ে তখন পাঞ্জাবে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ হলেও সাতসকালেই উদ্যান ভরে গেল উৎসাহী ক্রোধতপ্ত মানুষে। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে মুহূর্তেই গুলি ছুটল প্রতিবাদী জনসমষ্টির দিকে। সরকারি হিসাবে মারা গেল ৩৭৯ জন কিন্তু ধারণা করা হয়, আসল সংখ্যা এর থেকেও ঢের ঢের বেশি। উৎসব-আনন্দের বৈশাখী মুহূর্তেই পরিণত হলো ‘খুনি বৈশাখীতে’। এর পেছনে পাঞ্জাবের দুঃশাসক গর্ভনর মাইকেল ও’ডায়ারের ভূমিকাও ছিল নৃশংস।

এ ঘটনা জেনে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মর্মাহত হন, ওই সময়ের দুশ্চিন্তা ও রাগের প্রকাশ দেখা যায় ২২ মে ১৯১৯ সালে কিশোরী রানু অধিকারীকে লেখা এক চিঠিতে: ‘তোমরা তো পাঞ্জাবে আছ, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধ হয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে।…’ ২২ মে তারিখেই রবীন্দ্রনাথ আসেন কলকাতায়। মনের মধ্যে ক্ষোভ আগুনের মতো জ্বলছে, তা সত্ত্বেও বহিরঙ্গে নিজের কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছিলেন। 

কিন্তু একটা সময়ের পর আর পারলেন না। কথাবার্তা কমে যায় ও লেখালেখি বন্ধ করে দেন। মুখে হাসি নেই। শরীরও ক্ষোভে-রাগে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় তাঁর মাথায় একটি প্রতিবাদের পরিকল্পনা আসে। তখন পাঞ্জাবে অন্য এলাকার বাসিন্দাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, মহাত্মা গান্ধী আর তিনি মিলে প্রথমে দিল্লি গিয়ে তারপর যদি পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন, তাহলে একটা বড় প্রতিবাদ হয়। যদি তাঁদের ইংরেজ প্রশাসন গ্রেপ্তার করেও, তাতে প্রতিবাদের ও জনমনের প্রতিক্রিয়ার স্ফুলিঙ্গ আরও শক্তিশালী হবে। 

অতঃপর এই প্রস্তাবে গান্ধী রাজি হবেন কি না, তা জানতে তাঁর কাছে পাঠালেন সি এফ অ্যান্ডরুজকে। অ্যান্ডরুজকে গান্ধী ‘না’ বলে দেন এই বলে, ‘আমি এখনই সরকারকে বিব্রত করতে চাইছি না।’ ফিরে এসে অ্যান্ডরুজ যখন এ কথা রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, কবি স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তবে হতোদ্যম হননি। গান্ধীকে যখন সঙ্গে পেলেন না, তখন স্বভাষী রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর পাশে দাঁড়াবেন—এমনটা তিনি ভেবেছিলেন। তাই ২৯ মে বিকেলবেলা নিজেই যান তাঁর কাছে। 

রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড বর্জন।সংগৃহীত চিত্র

কিন্তু গান্ধীর মতো তিনিও কবিকে হতাশ করেন। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছিল, সেই বয়ান তিনি পরে জানান প্রশান্তকুমার মহলানবিশকে এভাবে: ‘মহাত্মাজী রাজি হলেন না পাঞ্জাবে যেতে। কাল তাই নিজেই গিয়েছিলুম চিত্তরঞ্জনের কাছে। বললুম যে, এই সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে তা অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদসভা ডাকো।’ এ কথা শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ সভা করার দায় ঘাড়ে নিতে চাননি। উল্টো রবীন্দ্রনাথ একাই একটা সভায় প্রতিবাদী বক্তব্য রাখবেন—এমন প্রস্তাব দেন তিনি। 

এ কথা স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, যদি একাই কিছু করতে হয়, তবে লোক ডেকে জড়ো করা কেন? অন্তরে বিপুল বেদনা ও রাগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই দিনই সিদ্ধান্ত নেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করে বড়লাটকে চিঠি লিখবেন। সারা রাত জেগে সেই ঐতিহাসিক চিঠির মুসাবিদা চলল। যখন ভোরের আলো ফুটছে, তখন লেখা শেষ হলো। 

প্রশান্তকুমার মহলানবিশ সে সময় ছিলেন কবির কাছেই। ওই সময় কবি তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই সম্মানটা ওরা আমাকে দিয়েছিল। কাজে লেগে গেল। এটা ফিরিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ করে আমার কথাটা বলবার সুযোগ পেলুম।’ ভোর শেষে সকাল হলে অ্যান্ডরুজ এলেন চিঠিটা নিতে। সেই সময় ঘটেছিল আরেক কাণ্ড। রবীন্দ্রনাথের ক্রোধতপ্ত চিঠির ভাষা খানিক নরমসরম করা যায় নাকি, এমন প্রস্তাব ছিল অ্যান্ডরুজের। এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

নাইটহুড পরিত্যাগের এ চিঠি গোটা বাংলা তো বটেই, দেশজুড়েই আলোড়ন তুলল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই, ওই রকম একক ও সাহসী প্রতিবাদের পরও রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে নানা নিন্দা-মন্দ প্রচার হতে শুরু করে। যেমন, ৩ জুন তারিখে নায়ক নামের এক পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘রবীন্দ্রনাথ উপাধী বর্জ্জন করিয়া নিজের সুবিধা কি করিয়াছেন তাহা জানি না, দেশের ও জাতির যে কোন সুবিধা করতে পারেন নাই, তাহা বলিবই। আমরা তাঁহার কার্য্যরে সমর্থন করিতে পারিলাম না।’ 

স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও একটি ব্যক্তিগত পত্রে রবীন্দ্রনাথের এই ‘জ্বলন্ত’ চিঠিকে ‘অকালপক্ক’ বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে চলতে থাকে আরেক খেলা, ইংরেজ কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের উপাধি ফেরত নিতে অক্ষম বলে নিজেদের দাবি করে কিছু চিঠিপত্র কবির কাছে চালাচালি করেন। সম্ভবত এই ছলচাতুরির উদ্দেশ্য ছিল কবিকে বিভ্রান্ত করা। 

কিন্তু কবি নিজের অবস্থানে ঠিকই অটুট থাকেন। বস্তুত নামের সামনে থেকে ইংরেজি ‘স্যার’-এর লেজুড়টুকু মুছে ফেলতে পেরে তিনি অনেকটা শান্ত হতে পেরেছিলেন। মনের বোঝা নামিয়ে লেখালেখিতেও তিনি দ্রুত ফিরে আসতে পারেন নাইটহুড উপাধি ত্যাগের পরই।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের পর পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনীতিবিদেরা যখন চুপচাপ থাকার পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেখানে নাইটহুড বর্জনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের একক প্রতিবাদ এই বর্বরতার দিকে বিশ্ববাসীর চোখ ফেরাতে পেরেছিল। 

তথ্যসূত্র: রবিজীবনী ৭ম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল। জালিয়ানওয়ালাবাগ: অ্যান এম্পায়ার অব ফিয়ার অ্যান্ড দ্য মেকিং অব অমৃতসর ম্যাসাকার, কিম এ ওয়াগনার। ‘স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের আয়োজন নিজেদের লজ্জাকেই স্থায়ী করার বন্দোবস্ত’, অভ্র ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ এপ্রিল ২০১৯।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#jalianwala bagh massacre, #Rabindranath Tagore

আরো দেখুন