বিবর্ণ রবীন্দ্র জয়ন্তী? আশঙ্কা শিল্পীদের
এ বার পয়লার মতো ২৫ বৈশাখও একেবারে বিবর্ণ হতে চলছে, যা অভিনব। তিন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কথায় স্মৃতির সঙ্গে মিশে গেল তীব্র আক্ষেপ। তুলে ধরলেন অভিজিৎ সেন
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র প্রয়াণ কক্ষ দেখতে উৎসাহীদের ভিড়। শুরু হয়েছে উদ্বোধন সঙ্গীত ‘হে নূতন।’ অন্য দিকে সল্ট লেকের সেন্ট্রাল পার্কের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তখন চাঁদের হাট। গ্রিনরুমে প্রবীণ শিল্পী আশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন বাচিক শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন এই প্রজন্মের শিল্পী রোহিণী রায়চৌধুরীর সঙ্গে। এর কিছু পরে নিউ টাউনের রবীন্দ্রতীর্থে শুধু হারমোনিয়াম নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তি চিত্রলেখা চৌধুরীর ‘যদি জল আসে আঁখিপাতে’ সৃষ্টি করছে সুরের মায়াজাল।
এ সবই অবশ্য অন্যান্য বছরের কথা। কারণ পয়লা বৈশাখের পর করোনা আতঙ্কের কবলে পড়তে চলেছে বাঙালির একান্ত আপন পঁচিশে বৈশাখও। রবীন্দ্রজয়ন্তীর দু’জন বিশিষ্ট উদ্যোক্তা জানালেন, যেখানে পাঁচজনের বেশি এক সঙ্গে জমায়েতের উপরে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেখানে এ ধরনের অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব রচনার এই যুগে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়তো এ বার সত্যিই হয়ে উঠবে ‘নির্জন এককের গান।’ কোথাও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে আবার কোথাও ‘বিজন ঘরে।’
রবীন্দ্র জন্মোৎসবের ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ উঠতে তিন শিল্পী উজাড় করে দিলেন অভিজ্ঞতার ঝাঁপি। চিত্রলেখা চৌধুরীর সঙ্গীতশিক্ষা শান্তিনিকেতনে ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং শান্তিদেব ঘোষের কাছে। সেখানে হারমোনিয়াম ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। অথচ কলকাতায় এসে চিত্রলেখা দেখলেন বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই বাদ্যযন্ত্র বলতে থাকে হারমোনিয়াম আর বাঁয়া-তবলা। চিত্রলেখা হারমোনিয়াম বাজাতে না জানায়, তাঁকে অপেক্ষা করতে হত। এক বারের কথা তিনি কখনও ভুলবেন না। ঘটনাটি তাঁর বয়ানেই শোনা যাক।
‘ছ’য়ের দশকের গোড়ার কথা। সেই সময় পঁচিশে বৈশাখের মূল অনুষ্ঠান হতো মহাজাতি সদন, মার্কাস স্কোয়ার, রবীন্দ্র কানন এবং অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস প্রাঙ্গণে। শেষ জায়গাটিতে এক বার গাইব ‘এ পরবাসে রবে কে হায়।’ কিন্তু বাজাবে কে? হঠাৎ উদ্যোক্তারা বললেন, ‘ওই তো এসে গিয়েছেন। আপনি শুরু করে দিন।’ আমার সামনে তখন কিংবদন্তি ভক্তিগীতি শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। অবাক হয়ে দেখলাম সেই গান পান্নালালবাবু কী অবলীলায় বাজিয়ে দিলেন! যত দিন হারমোনিয়াম বাজাতে শিখিনি তত দিন পর্যন্ত আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন কখনও নির্মলেন্দু চৌধুরী, কখনও শ্যামল মিত্র।’
চিত্রলেখার কাছে জানা গেল, সেই সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের প্রযোজনায় ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। সেখানে বালিকার ভূমিকায় থাকতেন তিনি আর বাল্মীকির ভূমিকায় অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুমিত্রা রায় যেমন আজও ভুলতে পারেন না ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ আর তার ঠিক পরের বছরগুলির কথা। তাঁর কথায়, ‘তখন আমাদের প্রবল ব্যস্ততা। রবীন্দ্রসদন থেকে ছুটছি বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে। চমৎকার একটা রবীন্দ্রমেলা হত বিডন স্ট্রিটে। একবার সুমিত্রা সেনের পরিচালনায় আমরা করেছিলাম ‘মেঘের পরে মেঘ’ নামে নৃত্যগীতিআলেখ্য।
সুবিনয় রায় ও মায়া সেনের কৃতী ছাত্রী সঙ্ঘমিত্রা গুপ্ত দেড় দশক অধ্যাপনা করেছেন বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনে। ফলে শান্তিনিকেতনেও এই অনুষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি সক্রিয় ভাবে যুক্ত থেকেছেন। তিনি বললেন, ‘তখন পয়লা বৈশাখেই রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালিত হয়ে দু’মাসের গরমের ছুটি পড়ে যেত।’
রবীন্দ্র জয়ন্তীর একাল-সেকাল নিয়ে সঙ্ঘমিত্রার সাফ কথা, ‘আমাদের সময় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাতেন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। আর এখন তো শুনি, ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠান করতে আগ্রহী শিল্পীদের অডিশন নেওয়াটাই রেওয়াজ।’
তথ্যসূত্র: অন্য সময়