বাংলার নবজাগরনের অন্যতম পথিকৎ ডিরোজিও
পনের শতকের দিকে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে পাশ্চাত্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। পাশ্চাত্যের নবজাগরণের ডাক এসেছিল ইতালিতে। এরই ফলশ্রুতিতে মানুষ সন্ধান করতে চেয়েছিল নতুন জীবনের, উন্মোচিত করতে চেয়েছিল অন্ধকার দূরীকরণের আলোক দ্যুতি। আর এই উন্মেচিত আলোক দ্যুতিই ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবজাগরণের সৃষ্টি।
ইউরোপে সৃষ্ট নবজাগরণ বাংলায় আসে এক ইউরোপিয়ানেরই হাত ধরে। তার রক্তে ইউরোপ থাকলেও তিনি নিজেকে দাবি করতেন একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে। বাঙলার জন্য অবাধ-নিরপেক্ষ আমরণ সংগ্রাম তিনি চালিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন বাংলার নবজাগরনের পুরোধা পুরুষ, ইয়ংবেঙ্গলের প্রাণপুরুষ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১)।
বিদেশি শাসকদের শোষণে-নিপীড়িত বাঙালির চিন্তা-চেতনা না পেরেছে স্বাধীনতা অর্জন করতে, না পেরেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে। আর এই সব সংকটকালীন মুহূর্ত উৎরিয়ে নেওয়ার মতো মহান সাধক বাঙালির ভাগ্যে খুব দেরিতে জুটেছে, তাও স্থুলভাবে। ডিরোজিও বাংলার মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিবন্ধকতা দূর করেছেন।
আমরা যদি একটু পশ্চাতে দেখি তাহলে দেখতে পাই সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহনের কত খ্যাতি। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ এবং নারী অধিকার সংরক্ষণসহ তিনি আরো কত সামাজিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু প্রকৃতার্থে বাঙালির চিন্তায়, সমাজে, রাষ্ট্রে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়নি। কারণ তার সংস্কারের প্রচেষ্টা ছিল গণ্ডিবদ্ধ পরিসরে।
রাজা রামমোহনের পরবর্তী সময়ে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১)-এর নাম এ প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিক। নবজাগরণের অর্থ ও তাৎপর্যের বিচারে ডিরোজিওর মাঝে ছিল নবজাগরণের চূড়ান্ত উপলব্ধি। এই উপলব্ধির কারণেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলেন। চিন্তার স্বাধীনতা ও গণমানুষের স্বাধীনতা অর্জনের নেশায় তিনি বিভোর ছিলেন। নবজাগরণের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি’। প্রকৃত বিচারে বাঙালি নবজাগরণে এই ‘ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি’ ছিল অগ্রগণ্য। আর ডিরোজিও ছিলেন নবজাগরণের প্রকৃত অগ্রদূত।
ডিরোজিও সময় পেয়েছিলেন খুবই স্বল্প। তবুও তিনি তার স্বল্প পরিসরের জীবনেও বাঙালির চিন্তা-চেতনায় বিরাট জায়গা করে নেন। ডিরোজিও আত্মোপলব্ধির পর তার লেখনিতে প্রকাশ পায় তার বাঙালিপনার। বারবার তার লেখনিতে দেশপ্রেম বোধ শাণিত তরবারির মতো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। দাসত্ব, অমানবিকতা, শৃঙ্খলিত, মনুষত্ববোধ এবং স্বদেশ মাতৃকাকে নিয়ে নিংড়ে ওঠা উৎকণ্ঠা আজও বিরল।
বাংলার সর্বজনীন ঐতিহ্য উপলব্ধি বারবার তার কবিতায় স্পন্দিত হয়েছে। এই উপলব্ধির পরিপূর্ণতা পেয়েছে তার কবিতায় নিপীড়িত জনগণের করুণ আর্তনাদ, মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বদেশপ্রেমের ধ্বনি।
পেশাগত দিক থেকে ডিরোজিও শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ইতিহাস পড়াতেন। ১৮২৬ সালের ১ মে মাত্র সতেরো বছর বয়সে সর্বসংস্কার মুক্ত যুক্তিবাদী দার্শনিক, স্বাধীন চিন্তার উপাসক, দেশপ্রেমিক ডিরোজিও হিন্দু কলেজে যোগদান করেন। যা এখন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত। শিক্ষকতাকালীন তিনি বাংলায় প্রচলিত সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের স্বাধীন ও নির্ভীকভাবে মত প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। তার আকর্ষণ ক্ষমতা ছিল চুম্বকের মতো। সে কারণে তার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করতে আগ্রহ জানাতেন। তার কাছ থেকে ছাত্ররা উদার নীতিমূলক শিক্ষা পেতেন। সত্য সন্ধিৎসা ও পাপের প্রতি ঘৃণা সমাজের শিক্ষিত সাধারণের মধ্যে তিনি বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ছিল উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেকে তার মহান আদর্শ, স্বদেশ প্রেম কিংবা মানবহিতৈষণার দ্বারা অভিভূত হতেন।
এই অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয়বোধ ও আদর্শবান ব্যক্তির চেতনাবোধ ছিল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। এত অল্প বয়সে যে নিজেকে এতটা সমৃদ্ধ করা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ ডিরোজিও নিজেই। এক কথায় ডিরোজিও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তার জ্ঞান প্রজ্ঞার বিশাল ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে ছিল সভ্যতা ও জাতিগত উন্নয়নের নিমিত্তে। অনেক টানাপড়েন, ক্লেদ, ঘাত-প্রত্যাঘাতের ভিতর দিয়েও তিনি বলেছিলেন সবচেয়ে সত্য কথাটি। চাকরি খুইয়ে যাওয়ার ভয় এমনকি জীবনের ভয় ও তাকে শঙ্কিত করতে পারেনি। দেশপ্রেম ও মানবমুক্তির পক্ষে তার কার্যক্রম ছিল প্রসংশনীয়।
তার চিন্তায় আমরা লক্ষ্য করেছি ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য স্বাধীনতা এবং মুক্তির এই ত্রিবিধ মৌল সত্য দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার এই দেশপ্রেম বোধের সাথে সংমিশ্রিত হয়েই রাজনৈতিক দর্শনের গভীরতার বোধ জেগেছিল। যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন ডিরোজিওর অবদান আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেছিল নিঃসন্দেহে। তাঁর সত্যতা ও সত্যানুসন্ধিৎসা অনুপ্রাণিত করেছিল আমাদের।
ডিরোজিও বাঙালির স্থবির চৈতন্যে আঘাত করেছিলেন। নিজের মাঝে যেমন মুক্তির জোয়ার ছিল, তেমনি এ জোয়ার সমগ্র গণমানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটি তিনি নিয়েছিলেন সাহসের সাথে। ইউরোপে সাংস্কৃতিক অচলায়তন ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে কোপারনিকাস, গ্যালিলিও স্কোটাস এরিজেনা এবং তার দুই শিষ্য রাসেলিনাস ও এ্যাবেলার্ড যেমন মুখ্য ভাষ্য কারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তেমনি বাঙালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
এ্যাংলো এশিয়ান হয়েও আন্তরিকভাবে বাঙালির মুক্তি চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন বাঙালিকে জ্ঞানে, চিন্তায় মননে নবতর চেতনায় জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন সত্যের মন্ত্রে বাঙালির মাঝে দ্রোহ ও বিপ্লবের উদ্রেক করতে যার ভিতর দিয়ে বাঙালির নবজাগরণ সম্ভব করে তোলা যায়।
আমাদের সমসাময়িক জীবনে যে সংকট, ক্রমবর্ধিষ্ণু সেই সংকটের ওপর পা রেখে দেখছি যে সামাজিক কাঠামো, তার আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ডিরোজিওর মতো যুক্তিবাদী দার্শনিক, প্রয়োজন ডিরোজিওর মতো সত্যবাদী, প্রগতিশীল ও সাচ্চা ব্যক্তিত্ব। যিনি লড়াই করবেন শোষণ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদী হবেন সামাজিক অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে, বজ্রকণ্ঠে গেয়ে যাবেন মানুষেরই গান।