লকডাউনে সুপারহিট আলুসেদ্ধ, ডিম আর সেদ্ধভাত
রোগশয্যায় শুয়ে মায়ের একটাই চাহিদা ছিল ছেলের কাছে। ছেলে প্যারিস-প্রবাসী মাস্টারশেফ, দুনিয়া জোড়া খ্যাতি। তাঁর কাছে মা খেতে চেয়েছিলেন শুধু মাছের ঝোল। সেই মা হলেন মমতা শঙ্কর। তবে সেটা রুপোলি পর্দায়। আর এখন, লকডাউনের বাস্তবে ওই বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মাছ খাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারছেন না।
তাঁর কথায়, ‘আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। কত মানুষ অভুক্ত, অর্ধভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। তাঁদের সবাইকে তো আমি সাহায্য করতে পারছি না। তবে অন্তত সমব্যথী টুকু তো হতে পারি।’ মমতা বলছেন, তাঁদের ঘরে একবেলা আলু-ঝিঙে পোস্ত বা ওই দু’টি আনাজ দিয়ে একটি ডালনা হলে পরের বেলায় সেগুলোর খোসার পদ রেঁধে খাওয়া হচ্ছে। পোস্ত ছড়িয়ে আলুর খোসা মুচমুচে করে ভাজা তো আছেই, তবে তাঁর বাড়িতে এখন সব চেয়ে বেশি চাহিদা ঝিঙের খোসা বাটার। তাঁর কথায়, ‘ঝিঙের খোসা মিহি করে ফেলতে হবে মিক্সিতে নেড়ে। তার পর সামান্য তেলে কালো জিরে-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন, নুন ও মিষ্টি দিতে হবে, শেষে সবটা কাঁচা তেল দিয়ে মাখতে হবে।’
বিশিষ্ট সাহিত্যিক বাণী বসুরও অভিমত, এখন যা পরিস্থিতি, তাতে প্রায় প্রত্যেকের হাতে রসদ সীমিত এবং এই অবস্থায় সাশ্রয় অত্যন্ত জরুরি, খাবারের ক্ষেত্রে কোনও জিনিস যেন নষ্ট না-হয়। লকডাউনে তাঁর হেঁশেলের ‘হিট’ পদ হল আলুর খোসা চচ্চড়ি। সাহিত্যিকের দেওয়া রেসিপি হল এই রকম, ‘আলুর খোসা মোটা মোটা করে কেটে রাখো, সঙ্গে অল্প একটু আলু ডুমো ডুমো করে। এ বার প্রেশার কুকারে খোসা আর আলু ভালো ভাবে সিদ্ধ করো। এই করোনার সময়ে যেন আবার পেট খারাপ না-হয়, সেই জন্য খোসা ভালো ভাবে সিদ্ধ করে নিতে হবে। আলু একটু গলে যাবে, তা যাক। তার পর তেলে পাঁচফোড়ন আর হিং দিয়ে খোসা আর আলু নাড়তে হবে নুন দিয়ে। শেষে কাঁচালঙ্কা দিয়ে নামাও।’
তবে শুধু সাশ্রয় নয়, করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনে বাড়িতে রান্নার লোকের গরহাজিরাও অনেকের সাদামাঠা খাবার খাওয়ার অন্যতম কারণ। গায়িকা ইন্দ্রাণী সেনের সাফ কথা, ‘রান্নার লোক আসছে না। এখন আমরা প্রায়ই সেদ্ধ-ভাত খাচ্ছি। যেমন উপাদেয়, তেমনই স্বাস্থ্যকর। ভাতের সঙ্গে আলু-কুমড়ো-মুসুর ডাল ও ডিমসেদ্ধ। আমার কর্তা আবার খুব ভালো সেদ্ধ মাখতে পারেন। সামান্য ঘি অথবা মাখন ও নুন-কাঁচালঙ্কা দিয়ে।’
আলুসিদ্ধ বস্তুটা ‘হট ফেভারিট’ সাংসদ ও কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়ের কাছে। তাঁর কথায়, ‘আমি শুধু আলুসেদ্ধ দিয়ে একথালা ভাত খেয়ে নিতে পারি। তেলে একটু পেঁয়াজ ভেজে নিয়ে সেটা নুন দিয়ে মাখতে হবে আলুসেদ্ধর সঙ্গে। অমৃত।’ পোড় খাওয়া ওই রাজনীতিক বলছেন, ‘ডিমের বাইরে তেমন আমিষ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সেই জন্য প্রায়শই ডিমের ডালনা রাঁধছি। যে কেউ মাছ-মাংস ফেলে ওটা খাবে।’
শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের হেঁশেলে এই সময়ে নিয়মিত ওমলেটের ডালনা হচ্ছে আলু দিয়ে। শাশ্বতী বলছেন, ‘ডিমের ডালনা অনেক সময়ে একঘেয়ে লাগে। তার বদলে ওমলেট কারি একটা বৈচিত্র্য এনে দেয়।’ আদা-জিরে ফোড়ন দিয়ে মুগডাল ও বিমস-টম্যাটো দিয়ে পনিরও এখন অনেক সময়েই হচ্ছে শাশ্বতীর বাড়ির রান্নাঘরে।
এই লকডাউন পর্বে খাবারের মধ্যে তাঁর সেরা আবিষ্কার কী? নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর মতে, পনিরের পাতলা ঝোল। তাঁর কথায়, ‘টাটকা পনির পাচ্ছি। একটু হলুদ, নুন আর টম্যাটোর রস দিয়ে রাঁধা পনিরের ঝোলটা যা সুস্বাদু হচ্ছে না, কী বলব! আমার স্বামী নিরামিষাশী। ফলে, উনিও এটা পছন্দ করছেন।’
বাঙালি রেস্তোরাঁ কিউপিজ-এর কর্ণধার রাখীপূর্ণিমা দাশগুপ্ত বলছেন, ‘সহজ ও সাশ্রয়কর অথচ সুস্বাদু একটি পদ হল আলু-ডিম ভর্তা। অল্প সর্ষের তেল গরম করে তাতে শুকনো লঙ্কা কুচি হাল্কা ভাজতে হবে। তার পর ওই তেল আর শুকনো লঙ্কা, নুন দিয়ে সিদ্ধ আলু ও ডিমের সঙ্গে মাখালেই ভর্তা তৈরি।’ ওই রন্ধন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সামান্য ও সাধারণ উপকরণ দিয়ে সুস্বাদু রান্নাটাই আসল চ্যালেঞ্জ এই লকডাউনের সময়ে।