নোবেলের সমান ভাগীদার হয়েও বঞ্চিত বাঙালি
ম্যালেরিয়া নিয়ে তখন গবেষণা করছেন রোনান্ড রস। কলকাতায় প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে শুরু হয়েছিল কাজ। তারপর উনি মহানাদ গ্রামে ল্যাবরেটোরি-সমেত বাংলো বানালেন। গবেষণার কাজে সহকারী প্রয়োজন। রীতিমতো ইন্টারভিউ নিয়ে তবেই সহকারী নিয়োগ করছিলেন রস-সাহেব। অনেকে ইন্টারভিউ দিয়েছে। তাদের মধ্যে একটা ছেলেকে দেখে তিনি সুগ্ধ। প্রেসিডেন্সী থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক, ইংরেজিতে তুখোড়, অসম্ভব ভালো রেজাল্ট। হাতেকলমে কাজের অভিজ্ঞতাও প্রচুর।
তবে, সাহেব মুগ্ধ হলেন ছেলেটার অন্য গুণের সন্ধান পেয়ে। গবেষণাগারে তো সে স্বচ্ছন্দ বটেই, সেইসঙ্গে গ্রামবাসীদের মধ্যেও তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা। ছেলেটার ঠাকুরদা বিখ্যাত কবিরাজ। পারিবারিক-সুত্রে পাওয়া আযুর্বেদের জ্ঞানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান-শিক্ষাকে মেলাতে জানে সে। তাঁকে গবেষণার সহকারী হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে আর দুবার ভাবেননি রোনান্ড রস।
বুদ্ধিমান ও মেধাবী রোনান্ড রস মানুষ চিনতে ভুল করতেন না সহজে। কিশোরীমোহনকে চিনতেও তাঁর ভূল হয়নি। ম্যালেরিয়া নিয়ে সেই গবেষণা সফল হল। ম্যালেরিয়ার জন্য যে স্ত্রী আানোফিলিস মশা দায়ী, তা আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯০২ সালে প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে নোবেল পেলেন রস সাহেব। অথচ গোটা বিশ্ব জানতেও পারল না, পানিহাটি থেকে গঙ্গা পেরিয়ে রোনান্ড রসের ল্যাবরেটরিতে আসা “সহকারী” কিশোরীমোহন না থাকলে সে-গবেষণায় সাফল্য আসতই না। রোনান্ড রস যে কৃতিত্বের জন্য নোবেল পেয়েছেন, সেই কৃতিত্বে সমান ভাগিদার ছিলেন বাঙালি “নেটিভ’ কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
রোনান্ড রসের কোনো কৃতিত্বকেই ছোটো করতে চাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু, এই আবিষ্কারের পিছনে কিশোরীমোহনের ভূমিকাও যে নেহাত কম ছিল না, তা ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন অনেক সাহেবও। অবশ্য, একজন সাহেবের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একজন বঙ্গসন্তানও নোবেল পদক গলায় ঝোলাবেন, এটা তো বাড়াবাড়িই বটে। যতই হোক, পরাধীন উপনিবেশের একজন নেটিভ বলে কথা। তাছাড়া, সরকারিভাবেও তিনি রোনান্ড রসের ‘ল্যাবরেটরি আযাসিসটেন্ট’। অতএব… ম্যালেরিয়া যে মশার কামড়েই হয়, সে-কথার আভাস কিশোরীমোহনের থেকেই পেয়েছিলেন রস সাহেব। ইংরেজরা আসার আগে থেকেই নাকি বাংলায় মশারি টাঙিয়ে শোওয়ার প্রচলন ছিল। মশা কামড়ালে যে জুর হয়, তাও বাঙালিরা জানতেন। কিন্তু সে-ই জুর যে ম্যালেরিয়া, তা অজানা ছিল। আযুর্বেদাচার্ধর নাতি কিশোরীমোহনও এই তথ্যের সঙ্গে পরিচিত ছোটোবেলা থেকেই। এই সূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক উপসংহারে পৌঁছোতে খুব সময় আর লাগেনি গবেষণায়।
অনুমান থেকে আবিষ্কারের সিদ্ধান্তে পৌঁছোতেও অবশ্য রস সাহেবকে অনেক সাহায্য করেছিলেন কিশোরীমোহন। পাশাপাশি, গবেষণার স্বার্থে পানিহাটি-সংলগ্ন অঞ্চল থেকে জুরাক্রান্ত রোগীদের তিনি নিয়ে আসতেন রোনান্ড রসের কাছে। এইসব রোগীদের অনেকেই কিশোরীমোহনের আয়ুর্বেদাচার্য ঠাকুরদার রোগী। তাদের সঙ্গে কথা বলে উপসর্গ, লক্ষণ-সংক্রান্ত তথ্য জোগাড়ের দায়িত্বও তাঁর ওপরেই ছিল। এই কাজ মোটেই একজন সামান্য “সহকারী”-র কাজ নয়, বরং সহ-গবেষকের কাজ। রোনান্ড রসের সাফল্যের সমান অংশীদার তাই কিশোরীমোহনও।
অথচ রস নোবেল পেলেন আর কিশোরীমোহন থেকে গেলেন ব্রাত্য। কলকাতায় প্রতিবাদ শুরু হল। এ তো অবিচার! সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রফুল্নচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা ছুটলেন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের কাছে। দাবি জুড়লেন, কিশোরীমোহনকেও সম্মানিত করা হোক রোনান্ড রসের সহ-গবেষক হিসাবে। চারপাশে হইচই শুনে কার্জন যা বোঝার বুঝলেন।
ঠিক হল, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কিশোরীমোহনকে সম্মানিত করা হবে। ১৯০৩ সালে দিল্লিতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে একটা বিশেষ স্বর্ণপদক দেওয়া হল কিশোরীমোহনকে। পদকের একপিঠে আযানোফিলিস মশার ছাপ ও কিশোরীমোহনের নাম। প্রায় হাতের সমান বড়োমাপের স্বর্ণপদকের ওজন তিন ভরি। সঙ্গে একটি মানপত্র, যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড স্বয়ং।
কিশোরীমোহন অবশ্য সেই অভিমান বয়ে বেড়াননি। রস দেশে ফিরে যাওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ম্যালেরিয়া নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। ম্যালেরিয়া নিয়ে সেই প্রচারের সময় কিশোরীমোহন প্রোজেক্টরের সাহায্যে সাইড দেখিয়ে বেড়াতেন। স্াইড তৈরিতে তাঁকে সাহায্য করতেন ভারতের প্রথম ভ্রাম্যমান ফটো-আটিস্ট লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী। তাঁতিদের মশারি বুনতেও উৎসাহ দিতেন কিশোরীমোহন।
কিন্তু, বিলেত থেকে কাপড় আনার প্রয়োজনে বাংলার তাঁতশিল্পকে তখন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। মিলের তৈরি কাপড়ে তো মশারি হয় না। ফলে, মাছ ধরার জালকেই আরো সুষ্ক্রভাবে বুনে মশারির কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিশোরীমোহন। গবেষণার সূত্রেই দেখেছিলেন, গ্রামবাসীদের আর্থিক দুরাবস্থার কথা। তাই কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চালু করেছিলেন পানিহাটি কোঅপারেটিভ ব্যাংক। সেই ব্যাংক আজো জীবিত।
সাহেবদের অভিসন্ধি নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু আমরা কীভাবে ভুলে গেলাম কিশোরীমোহনকে? যে-মানুষটার হাত ধরে প্রথম নোবেল পুরস্কার আসতে পারত বাংলায়, তাঁকে মনে না রাখাও তো অপরাধ। যে জাতি নিজেদের গৌরব ভুলে যায়, তাদের ইতিহাসকেও ভুলিয়ে দেওয়া সহজ, তাই না?