বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

আইজাক আজিমভ ও সত্যজিৎ রায়

May 2, 2020 | 2 min read

যারা প্রোফেসর শঙ্কুকে চেনেন, তারা সবাই যে ডক্টর সুজান কলভিনকে চিনবেন, এমন কোনো কথা নেই। শঙ্কু যেমন বৈজ্ঞানিক, সুজানও তেমন। সুজান যে মহিলা, তা তো নামেই বোঝা যাচ্ছে। আমেরিকার একটি সংস্থা ‘ইউএস রোবটস অ্যান্ড মেকানিক্যাল ম্যান, ইন্ক্.’-এ কাজ করেন সুজান। তার ডেজিগনেশন রোবোসাইকোলজিস্ট।

অনেক কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী আছেন, যারা অনুমান করেন সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট কল্প-বৈজ্ঞানিক চরিত্র অধ্যাপক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু বুঝি সত্যজিতের পিতৃদেব সুকুমারের গল্পের অভিযাত্রী বৈজ্ঞানিক হেঁশোরাম হুঁশিয়ার কিংবা গবেষক বিজ্ঞানী প্রোফেসর নিধিরাম পাটকেলের আদলে তৈরি। 

আরো একটা থিওরি নতুন উঠে এসেছে, তা হলো সত্যজিতের কাকা সুবিনয় রায় চৌধুরীর লেখা কয়েকটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আত্মম্ভরী ঘোষের সঙ্গে নাকি ত্রিলোকেশ্বরের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু যে যা-ই বলুন, শঙ্কুকে তার পাঠকরা যতই একজন বয়স্ক, টাকমাথা, সাদা দাড়ি-গোঁফের ঋষিতুল্য মানুষ হিসেবে দেখুন, মার্কিন রোবোসাইকোলজিস্ট সুজান কলভিনের সঙ্গে শঙ্কুর অনেক সাদৃশ্য কিন্তু বড়ই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে, যদি এই দুজনের জীবন খতিয়ে দেখা যায়।

আইজাক আজিমভ ও সত্যজিৎ রায়

সত্যজিতের শঙ্কু তার ডায়েরিতে লিখেছেন, তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছেন ১২ বছর বয়সে, চৌদ্দোয় আইএসসি আর ষোলোয় ফিজিকস ও কেমিস্ট্রিতে ভালো অনার্স নিয়ে বিএসসি। এই ১৬ বছর বয়সেই এক কাণ্ড করেছিলেন সুজান, ডক্টর অ্যালফ্রেড ল্যানিংয়ের একটি সাইকো-ম্যাথ সেমিনারে উপস্থিত থাকার পর ‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাসপেক্টস অব রোবোটিকস’ শীর্ষক একটি পেপার লিখে বিজ্ঞানী মহলে হইচই ফেলে দেন।

সুজান কলভিন জন্মসূত্রে রুশ, কিন্তু বছর তিনেক বয়সে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় চলে এসে আমেরিকান হিসেবেই জীবন অতিবাহিত করা বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজাক আজিমভের অনেকগুলো গল্পের নায়িকা। নায়িকা বলা অবশ্য ঠিক হলো না। কারণ তার বিপরীতে কোনো নায়ক কখনো ছিল না। সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তাই সুজান কলভিনকে গল্পগুলোর ‘প্রোটাগনিস্ট’ বলেই বোঝাতে হচ্ছে।

রোবট বিশেষজ্ঞ, সুন্দরী যুবতী বৈজ্ঞানিক সুজান শঙ্কুর মতো ডায়েরি লিখতেন না ঠিকই। তিনি বিভিন্ন ঘটনা নিজ মুখে বলতেন এক সাংবাদিককে। আর সেই সাংবাদিক লিখতেন রোবটদের বিভিন্ন কাণ্ড সম্পর্কে গল্পের মতো করে। ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর জীবন যেমন স্ত্রী-ভূমিকা বর্জিত, প্রায় সেই রকমই পুরুষ-ভূমিকা বর্জিত জীবন সুজানের। আজিমভের রোবট-বিষয়ক প্রায় প্রতিটি গল্পে একটি করে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রোবট দেখা যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কলভিন বা অন্য কাউকে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে হয়।

সত্যজিতের বিভিন্ন গল্পে যে সামান্য কয়েকটি রোবট দেখা গেছে, তাদের মধ্যেও কিন্তু কতকটা ওই ধরনের বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠত। এই বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব কিন্তু রোবটের নির্মাতারা আরোপ করেননি। সত্যি বলতে কি, এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক রোবটসুলভও নয়। বরং এগুলোকে মানবিক বলা যায়। সত্যজিতের বিধুশেখর যেমন নিজ থেকে শঙ্কুকে নিয়ে চলে গিয়েছিল অন্য এক গ্রহে বা অনুকূল যেমন বুঝতে পেরেছিল কী করে তার মনিবকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। এগুলো তাদের মধ্যে ‘প্রোগ্রামড’ হয়ে থাকার কথা ছিল না। 

ঠিক এইভাবেই আজিমভ-এর ‘এসকেপ!’ গল্পের রোবট ‘দ্য ব্রেন’ মহাকাশে গিয়ে নভশ্চরদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করে দিয়েছিল বা ‘লায়ার!’ গল্পের হারবির মধ্যে দেখা যায় টেলিপ্যাথিক অনুভূতি; কিংবা ছোট্ট মেয়ে গ্লোরিয়ার সঙ্গে ‘রব্বি’ গল্পের রোবটের এক অদ্ভুত স্নেহের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়।

বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে সত্যজিৎ জানিয়েছেন, সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে তার পরিচয় ১০ বছর বয়স থেকে। প্রায় একই রকম বয়স থেকেই কল্পবিজ্ঞানের ভক্ত হয়ে ওঠেন আজিমভ। তার লেখালেখির শুরু ১১ বছর বয়সে। সেই অভ্যাস এমনই আকার ধারণ করেছিল যা দেখে আইজাকের বাবা ছেলেকে একটি টাইপরাইটার কিনে দিয়েছিলেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব-রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন আজিমভ, তবে তার আসল পরিচয় কিন্তু একজন যথার্থ, সফল ও জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে, সেই বিচারে সত্যজিৎ রায় মানুষটির কাজকারবার ছিল একেবারে আলাদা। 

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Satyajit Ray, #Issac Asimov

আরো দেখুন