করোনা-পরবর্তী বিশ্ব শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখবে
ভয়াল কোভিড-১৯ বিশ্বে সর্বক্ষেত্রে নিজের ছাপ রাখছে। শিক্ষাও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের পর দেশ যখন করোনার মোকাবিলায় লকডাউনকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নিচ্ছে, তখন ইন্টারনেট শিক্ষাই একমাত্র উপায়।
ভারতবর্ষের মতো দেশে অন্তর্জালের লভ্যতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। এখনও এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রের কাছে অন্তর্জালের সুবিধে নেই। তাই অনলাইন শিক্ষার সুবিধা তাঁরা নিতে অক্ষম। যদিও ৭০ শতাংশ ভারতীয়র কাছে এখন মুঠোফোন আছে, তবুও অনলাইন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যে পরিকাঠামো প্রয়োজন সেই পরিকাঠামো এখনও এক বৃহৎসংখ্যক ছাত্রের কাছেই নেই।
তবে এটাও সত্যি যে যদি কোভিড-১৯ আমাদের আক্রমণ না করত, তা হলে অনলাইন শিক্ষা একটা অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যেত। বিমুদ্রাকরণ ভারতের অর্থনীতিতে যে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছিল, করোনার আগমন শিক্ষাক্ষেত্রেও ঠিক সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনই এনেছে।
দেখে নেওয়া যাক, এই পরিবর্তনগুলো:
১) এখন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং সফটওয়্যারগুলির মাধ্যমে। এখন একটা লেকচারকে অনলাইন ক্যামেরার সাহায্যে রেকর্ড করা সম্ভব। এতে ভবিষ্যতের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক দলিল তৈরী হয়।
২) হাতে লেখা কাগুজে টিকাকে প্রতিস্থাপন করেছে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বা পিডিএফ বা ওয়েবসাইট লিংক বা ইউটিউব লিঙ্ক। অনলাইন মাধ্যমগুলোর সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে সহজ সংরক্ষণ। তাই শিক্ষাদানের পরেও ছাত্ররা নিজেদের সময়ানুসারে অনলাইন সংস্থানের সাহায্য নিতে পারছে।
৩) উপস্থিতি নথিভুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গুগল স্প্রেডশিট এবং গুগল ক্লাসরুম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও উপস্থিতির নথি রাখা হচ্ছে। এখানেও কোনও কারচুপির জায়গা নেই। যা হচ্ছে তা সাদাকালো নথির সাহায্যেই হচ্ছে। এই নথি দরকার মতো প্রশাসনিক প্রয়োজনেও ব্যবহার করা সম্ভব।
৪) অনেক ক্ষেত্রে আগের থেকেই পাঠ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ক্লাসের সময় শুধুমাত্র সন্দেহ দূরীকরণ হচ্ছে। এতে প্রথাসর্বস্ব এবং অগণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সংগঠিত হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একপেশে লেকচারের দিন শেষ। শিক্ষাকে দক্ষতায় পরিবর্তন করা এখন শিক্ষকের অবশ্যকর্তব্য।
৫) আজকের যুগ মিশ্র শিক্ষার যুগ। তাই করোনা-পরবর্তী জগতে ৪০ শতাংশ পাঠ অফলাইন গতানুগতিক পন্থায় দেওয়া হবে। বাকি ৬০ শতাংশ অন্তর্জাল-ভিত্তিক শিক্ষা হবে। এতে এক জন ছাত্রের বুদ্ধিগত বিকাশ সম্ভব। করোনা-পরবর্তী পৃথিবী অনলাইন শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেবে। তাই এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।
৬) দূরশিক্ষণ শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব আনতে চলেছে। ক্যাম্পাস-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব। ছাত্ররা ঘরে বসেই পড়াশোনা করবেন নানান অভিনব পন্থা ব্যবহার করে। তাই ভবিষ্যতে কাজ এবং পড়াশোনা, দুটোই চালিয়ে যাওয়ার অপরিমিত সুযোগ থাকবে।
৭) শিক্ষা আর ডিগ্রীসর্বস্ব থাকবে না। যে শিক্ষা দক্ষতা দান করে না, সেই শিক্ষার আর কোনও মূল্য থাকবে না। কাগুজে ডিগ্রীর দিন শেষ হতে চলেছে। করোনার আগমন মনুষ্যসমাজকে বুঝিয়ে দিচ্ছে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার দাম।
৮) মূল্যভিত্তিক শিক্ষাই হবে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর পাথেয়। এই মহাদুর্যোগ মানুষকে নতুন করে মনুষ্যত্ব শেখাচ্ছে। বাজারকেন্দ্রিক সভ্যতা থেকে মানুষ আবার সহমর্মিতা-চালিত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তনের পিছনে শিক্ষা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
৯) করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে সামাজিক মাধ্যম শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষক এবং ছাত্র ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং লিঙ্কেডিন স্লাইডশেয়ার ইত্যাদির সাহায্যে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে স্থান এবং কাল ভবিষ্যতে শিক্ষার ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যাবে।
১০) সেই দিন আর খুব দূরে নেই যখন পরীক্ষা মুখস্থবিদ্যার উপর ভিত্তি করে হবে না। ভবিষ্যতে পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ বিশ্লেষণাত্মক হবে এবং ছাত্রদের আরও সৃষ্টিমূলক হতে হবে।
কেউ যদি মনে করে থাকেন যে এই সব পরিবর্তন সাময়িক এবং করোনামুক্তির সঙ্গে আবার আমরা পুরনো শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন করতে পারব, তা হলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। শিক্ষা চিরতরে পাল্টাচ্ছে এবং যাঁরা এই বদলের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবেন না, তাঁরা নিজেরাই কার্যত ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবেন।