লকডাউনের জেরে একগুচ্ছ সমস্যার মুখে চা বাগানগুলি
চালু, অচল, বন্ধ-সব চা বাগানেই দৃশ্যটা প্রায় একই রকমের। লকডাউন বিধির জেরে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শ্রমিক কাজ করতে পারছেন না। ফলে, চা গাছগুলি উপযুক্ত যত্ন পাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই, লকডাউনের পর স্বাভাবিক ছন্দে বাগান চালু হলেও উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলির কর্মকর্তারা।
এদিকে, লুপার নামে পোকার আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চা গাছের পাতাগুলি। আবার, মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক কাজ করার জন্য রোগ পোকা আটকাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি, এই ফাঁকে চা বাগানগুলিতে ঝোপঝাড়ও বাড়ছে। তাতে চা বাগান মহল্লাগুলিতে কিছুদিন পরই চিতাবাঘের উৎপাত বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চা বাগানের বাসিন্দারা।
চালু চা বাগানগুলির চেয়ে বন্ধ চা বাগানগুলিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক কারণেই খারাপ বরাবরই। এছাড়া, বন্ধ চা বাগানগুলির শ্রমিকরা পাতা তুলে বিক্রি করলেও সাধারণত খোলা চা বাগানের মতো গাছগুলির যত্নআত্তি করতে পারেন না মূলত আর্থিক সঙ্গতির অভাবেই। তবুও পিক সিজনে পাতা বিক্রি করে কিছুটা হলেও আর্থিক লাভ করেন বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক কর্মচারিরাও। কিন্তু লকডাউনের জেরে ভীষণভাবে বিপাকে পড়েছেন তাঁরাও। তবে লকডাউনের মধ্যেও তাঁরা আঁকড়ে ধরে রয়েছেন চা বাগানকে। পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেও চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব চা গাছগুলির পরিচর্যা করার।
চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য উত্তম সাহা বলেন, ‘মার্চ এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি ভালো পাতা পাওয়া যায়। কিন্তু ঠিক এ সময়ই লকডাউনের খাঁড়া নেমে এসেছে। তার ওপর বাগানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পোকা। কিন্তু, লকডাউনের জেরে বর্তমানে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শ্রমিক কোথাও কাজ করতে পারছেন না। তাই, গাছগুলির যত্নআত্তি করা যাচ্ছে না। লকডাউন উঠলেও ব্যাপক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়তে চলেছে বাগানগুলি। তাই আমরা দাবি জানানোর পর পঁচিশ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগদানের অনুপাত পঞ্চাশ শতাংশ করা হয়েছে। আমরা চাই, চা বাগানে একশো শতাংশ শ্রমিককে কাজ করতে দেওয়া হোক। কারণ, চা বাগানেই একমাত্র স্যোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রেখে কাজ করা সম্ভব।’
বীরপাড়া চা বাগানটি গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে অচল হয়ে রয়েছে। এতদিন ধরে শ্রমিকরাই চা গাছগুলির যত্নআত্তি করতেন, কারণ চা পাতা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা। কিন্তু লকডাউনের বিধির জেরে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শ্রমিক কর্মচারি কাজ করতে পারছেন না।
ওই চা বাগানের শ্রমিক বিনোদ টোপ্পো বলেন, ‘বাগানের ঝোপঝাড় দ্রুত বাড়ছে। এমনিতেই বীরপাড়া চা বাগানে চিতাবাঘের ঘাঁটি রয়েছে। ঝোপঝাড় বেড়ে যাওয়ায় চিতাবাঘের হানার আশঙ্কা আরও বাড়ছে।’ ওই চা বাগানের শ্রমিক ঘুরা কুজুর বলেন, ‘যত্ন না নিলে চা গাছের পাতার গুণমান খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু নিয়মের জন্য চা গাছগুলির যত্নআত্তিও করা যাচ্ছে না। তার ওপর পোকা হানা দিয়েছে। আগামীতে সংকট দেখা দেবে।’ একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্যারগান্ডা, হান্টাপাড়া, ধূমচীপাড়া, তুলসিপাড়ার মতো খোলা চা বাগানগুলির শ্রমিক কর্মচারিরাও।
প্রসঙ্গত, মাদারিহাট বীরপাড়া ব্লকের চা বলয়ে চিতাবাঘের আক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত ১৭ মাসে মাদারিহাট বীরপাড়া ব্লকে চিতাবাঘের আক্রমণে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। জখম হয়েছেন সাত জন। উল্লেখ্য, মৃত্যু ও জখমের প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটেছে চা বলয়ে। গত ১৭-১৮ মাসে মাদারিহাট বীরপাড়া ব্লকের চা বাগানগুলি থেকে পনেরোটিরও বেশি চিতাবাঘ খাঁচাবন্দি করেছে বনদপ্তর। তবে, বন্ধ হয়নি চিতাবাঘের হানার ঘটনা। গত ১৮ এপ্রিলও বীরপাড়ার বন্ধ ঢেকলাপাড়া চা বাগানের নেপ্পানীয়া ডিভিশনে দিবালোকে চিতাবাঘের হানায় জখম হন এক যুবক।
বনদপ্তর জানিয়েছে, চা বাগানকে সাধারণত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় চা বাগানকেই। তাই চা বাগানের ঝোপঝাড় নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। দলগাঁওয়ের রেঞ্জার দোরজি শেরপা বলেন, ‘আমরা চা বাগানগুলির ওপর নজর রাখছি। চিতাবাঘের আনাগোনার খবর পেলে খাঁচা পাতা হচ্ছে।’ চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের সহ সভাপতি মান্নালাল জৈন বলেন, ‘লকডাউনের জেরে একগুচ্ছ সমস্যার মুখে পড়েছে চা বাগানগুলি।’