ঋতুপর্ণ – একজন শিল্পীর কোনও লিঙ্গ হয় কি?
এমন নয় যে শুধু আজকের দিনটিতেই ঋতুপর্ণকে মনে পড়ে সকলের। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর মতো মেধাবী, প্রতিভাবান একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন।
কিন্তু যখনই তাঁর প্রসঙ্গ আসে, তখনই একটা প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসে। ঢাক ঢাক, গুড় গুড়। কানাকানি, ফিসফাস। ঋতুপর্ণ ঘোষ কি পুরুষ ছিল নাকি নারী? নাকি নারী-পুরুষ দুটোই ছিলেন? অনেকের মন্তব্য, ঋতু ট্রান্সজেন্ডার, পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী। যার যা খুশী বলে, মন্তব্য করে। ঋতুপর্ণকে নিয়ে এখনো রীতিমত বিতর্ক হয়, খুব ক্লিশে বিতর্ক, বিতর্ক স্রেফ ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘লিঙ্গ’ নিয়ে!
ঋতুপর্ণ মানুষ ছিলেন। শুধু মানুষ। মানবিক একজন মানুষ। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। দাঁড়াতে পেরেও ছিলেন যিনি, তিনিই ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই বামন সমাজে ঋতু অতিকায়, যার উচ্চতা আকাশছোঁয়া, ফলে ঋতুকে আমাদের কাছে কদাকার লাগার, ভাবার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ রয়েছে।
ঋতুপর্ণ বরাবরই চাপাপড়া, ঢেকে রাখা, না বলা, রাখঢাক করা সামাজিক যৌনতার গোপনীয়তা ভেঙেছেন। ভেতরকার তীব্র যৌন অবদমনকে বাইরে নিয়ে এসেছেন। মনে আছে, অন্দরমহলের (২০০৫) কথা? শুরুতেই সঙ্গমদৃশ্য। নপুংসক জমিদার স্বামীর পুত্রবাসনা পূরণের জন্য তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী যশোমতীকে প্রতি রাতে যন্ত্রণাকাতর সঙ্গমের শিকার হতে হয়। দৃশ্যটি বেদনার, যৌন উত্তেজনার নয়।
যৌনতা ও শরীরকে তিনি প্রয়োগ করেছেন পুরুষতন্ত্র, তার নীতিনৈতিকতা, অবদমন এবং নারী-পুরুষবাচক বাইনারি লিঙ্গীয় পরিচয়ের পাঁচিল ভাঙার অস্ত্র হিসেবে। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ কিংবা ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ ছবিগুলোর কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে। প্রচলিত আর্ট ফিল্মের বাধা ছাঁচের বাইরে গিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ দেখিয়েছেন ভিন্নমাত্রার এক সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন।
যৌনতার আধুনিক তত্ত্ব বলে, কামের ক্ষেত্রে দুনিয়ায় আদতে বিষম বলে কোনও মেরু নেই। সেক্সুয়ালিটির বিষয়টি মূলত খুব ফ্লুইড। সবার মধ্যেই সব লিঙ্গীয় যৌনতার আকাঙ্ক্ষা থাকে। যৌনতার ক্ষেত্রে দ্বিমেরু বিভাজন নিতান্তই অর্বাচীন। আসলে, প্রত্যেকেই নিজের শরীরকে অদম্য ভালোবাসে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। নারী কিংবা পুরুষের স্বমৈথুন তার এক অসাধারণ প্রমাণিত উদাহরণ। ছবিতে ঋতুপর্ণ জরুরি কিছু প্রশ্ন তোলেন। জগৎ শরীর নিয়ে আমরা যদি সুখী হই, তা হলে ছেলেরা চুল, নখ কাটে কেন? মেয়েরা কান বেঁধায় বা উল্কি কেন আঁকে?
ঋতুপর্ণ সব সময় বলতে চেয়েছেন, শিল্পীর কোনও জেন্ডার হয় না। বরং জেন্ডারকে একমাত্র মহান শিল্পীরাই অতিক্রম করে যেতে পারেন।