বর্ণ বৈষম্য ও ভারতের পুরাণ
সম্প্রতি আমেরিকায় ঘটে যাওয়া কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের বর্বরোচিত অত্যাচারের প্রসঙ্গ উঠে আসছে বারবার করে নেটদুনিয়ায়। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে শোকাতুর সারা বিশ্ব। এই ঘটনায় প্রতিবাদে মুখর ভারতও। কিন্তু জানেন কি, ভারতীয় পুরাগাঁথায় কৃষ্ণাঙ্গ দেবদেবীর উল্লেখ অজস্র। অবশ্য, কালের নিয়মে সেই কথা এখন অনেকটাই বিস্মৃত।
মুনি ঋষিরা যখন পুরাণ লিখে গেছেন সেই সময়ের উদার মানসিকতার যে উল্লেখ আমরা পাই তা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ক’জন ভাবতে পারে তা সম্পর্কে সংশয় আছে বইকি। ভারতে বর্ণবাদ সম্পূর্ণ কদাকার রুপ নিয়ে প্রকট হচ্ছে মধ্যযুগ থেকে। অথচ পুরাণ যদি ঘেঁটে দেখা যায় সেখানে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা অমাবস্যার অন্ধকারের মতো মহাকালীর মাহাত্মের কথা জ্বলজ্বল করছে।
কালীর কথা বাদ দিয়েও, আমরা যদি বাকী দেবীদের দেখি সেখানে ‘দেবী দুর্গা’ কিন্তু “অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা”। আগুনের রঙকে আমরা কখনোই তথাকথিত ফর্সা বলতে পারি না। দশমহাবিদ্যার মধ্যে ‘কালী’ কালো, ‘তারা’ ঘন নীল, ‘ছিন্নমস্তা’ লালচে, ‘ধুমাবতী’র শরীর ঘন ধোঁয়ার মতো আর ‘মাতঙ্গী’ সবুজ।
অর্থাৎ দশজনের মধ্যে পাঁচজনই ফর্সা নন। বরং একেকজন একেক রকমের “অফর্সা”। নবদূর্গার সপ্তম রুপ কালরাত্রি (ঘোর কালো) আর অষ্টম রুপ মহাগৌরী (ভীষণ ফর্সা) – এদের মাহাত্মের কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে কি? নিশ্চিন্তে দুজন পাশাপাশি বিরাজমানা। ‘মহালক্ষ্মী’র গাত্রবর্ণ তামাটে, অর্থাৎ আর যাই হোক ফর্সা নয়।
এবার আসি ‘সরস্বতী’ প্রসঙ্গে। এখানে তার গাত্রবর্ণ একটা রুপক মাত্র। জ্ঞানের অপর নাম সত্য আর সত্য শব্দের প্রতীকী বর্ণ সাদা। কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে, সরস্বতীর শরীর সাদা কিন্তু ফর্সা নয়। অর্থাৎ আমরা ফর্সা বলতে যে দুধে আলতা রংটাকে বুঝি তা তিনি কখনোই নন। বরং আমাদের আশেপাশে যদি সত্যিই সরস্বতীর মতো সাদা কোনো মেয়ে আসে আমরা তাকে স্বেতি রোগী বলে তাচ্ছিল্য করব আর কিছুই নয়।
দেবতাদের মধ্যে ‘শ্রী বিষ্ণু’র গাত্র জলভরা মেঘের মতো। ‘মহাদেব’ গায়ে ছাই মেখে থাকতেন বলে ফর্সা লাগে তাকে কিন্তু তাঁর ও আসল রঙ ফর্সা নয়। অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে দেবদেবীদের অপার বিশ্বমোহিনী সৌন্দর্যের পথে গায়ের রঙের স্বচ্ছতা কিংবা অস্বচ্ছতা কিন্তু তখনকার মুনি ঋষিদের মনে কোনোরকম দ্বিধা সৃষ্টি করেনি।
দেবদেবী ছাড়াও, আমরা যদি মহাকব্যেও দেখি, সেখানে প্রধান চরিত্রদের গায়ের রঙও কিন্তু ফর্সা নয়। মহাভারতের কথাই ধরুন না। প্রধান চারজন কেন্দ্রীয় চরিত্র – কৃষ্ণ, অর্জুন, দ্রৌপদী আর সত্যবতী। কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো। অর্জুনের ডাকনাম কালা, অর্থাৎ সেও ফর্সা নয়। এবারে আসি দ্রৌপদীর কথায়। “শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী” অর্থাৎ গায়ের রঙ কালো কিন্তু চোখের পাতা পদ্মের পাপড়ির মতো। খানিকটা রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলির মতো।
অথচ এই দ্রৌপদীর জন্য দেশ-বিদেশের রাজারা পাগল হয়ে উঠেছিল। কারণ তার ব্যক্তিত্ব, দৃপ্ত বাচন ভঙ্গি আর ক্ষুরধার বুদ্ধি। অর্থাৎ “কালো মেয়ের বিয়ে কি করে হবে মশাই” এই কথাটাকে যদি কেউ দুপায়ে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিতে পারে তা এই কৃষ্ণা ছাড়া আর কেউ নয়।
অবশ্য আর কেউ নয় বলাটা ভুল হল। আরেকজন ছিল এই তিনজনের ও তিন প্রজন্ম আগে। দাশরাজ কন্যা সত্যবতী। তার ডাকনাম কালী, কারণ? সেই গায়ের রঙ। দ্রৌপদী তো তাও শ্যামা আর এ তো নাকি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। অথচ এনার রুপে প্রথমে কুপোকাত হলেন পরাশর মুনি তারপর রাজা শান্তনু।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষত্রিয় সবাইকে ঘোল খাইয়ে দিল একজন কালো মেয়ে। এরপরেও বলবেন “মেয়ে কালো তো, কে বিয়ে করবে একে?”
তথ্যসূত্র: সৌম্যপ্রভ গাঙ্গুলী