চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধি – সংকটে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল
চাপের মুখে মুমূর্ষু, সংকটজনক রোগী ছাড়া বাকিদের ভর্তি না করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যেভাবে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে দুই সপ্তাহ বাদে মেডিকেলে কতটা চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয়ে চিকিৎসকরাই। তাঁদের বক্তব্য, একজন সংক্রামিত হলে অন্তত ১০-১২ জনকে কোয়ারান্টিনে পাঠাতে হচ্ছে। প্রতিদিন তিন-চারজনের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ছে। ফলে কিছুদিন পরে পরিস্থিতি কী হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। আগামীতে এখানে পরিষেবা দেওয়া কঠিন হবে।
উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে জুনিয়ার, সিনিয়ার মিলিয়ে ইতিমধ্যেই অন্তত ১০ জন চিকিৎসক ছাড়াও কয়েকজন নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রামিত হয়েছেন। এঁদের সংস্পর্শে আসায় ১০০ জনেরও বেশি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীর সংখ্যা প্রতিদিনই কমছে। এই পরিস্থিতিতে গত শনিবার মেডিকেল সুপার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে মেডিকেলে খুব সংকটজনক রোগী ছাড়া বাকি কোনও রোগী ভর্তি করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যেভাবে চিকিৎসক থেকে সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রামিত হচ্ছেন তাতে সব বিভাগ মিলিয়ে ১০০০-১১০০ রোগী রেখে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই জন্যই স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত নেওযা হয়েছে। এই নির্দেশিকা ঘিরে স্বাস্থ্য দপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলে হইচই শুরু হয়। এরপরেই সোমবার উত্তরবঙ্গে কোভিড-১৯ মোকাবিলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) ডাঃ সুশান্ত রায়ের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। তাঁর চাপেই হাসপাতাল সুপার ওই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নেন এবং জানিয়ে দেন, সমস্ত রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করা হবে।
উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে জুনিয়ার ডাক্তার, ইন্টার্ন, হাউস স্টাফ মিলিয়ে ২৩০ জন, সিনিয়ার ডাক্তার রয়েছেন ৩০০-র কিছু বেশি। সব মিলিয়ে ৫০০-র বেশি চিকিৎসক রয়েছেন। এঁদের মধ্যে সরাসরি রোগী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত নন, যেমন অ্যানাটমি, মাইক্রোবায়োলজির মতো বিভাগের চিকিৎসকরাও রয়েছেন। চিকিৎসকদের একটা অংশের পোস্টিং উত্তরবঙ্গ মেডিকেলে হলেও তাঁরা কলকাতাতেই থাকেন। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। পাশাপাশি, কোভিড-১৯এর চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি যে বিভাগগুলি যুক্ত সেই বিভাগের সমস্ত চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসাকর্মীকে কোয়ারান্টিনে রাখার মতো ব্যবস্থাও নেই। শুধু মাত্র সার্জিক্যাল আইসোলেশনে ডিউটিরত চিকিৎসক ও নার্সদেরই কোয়ারান্টিনে রাখা হচ্ছে। ফলে একজন সংক্রামিত হলে অনেককেই কোয়ারান্টিন করতে হচ্ছে। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক তথা স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্সের ডিন ডাঃ সন্দীপ সেনগুপ্ত বলেন, প্রতিদিনই চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই সংক্রামিত হচ্ছেন। তাঁদের সংস্পর্শে আসা অনেককেই কোয়ারান্টিন সেন্টারে রাখতে হচ্ছে। ফলে চিকিৎসক, নার্সের সংখ্যা যেমন কমছে, তেমনই স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাও কমছে। এর আগে যাঁরা সংক্রামিত হয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে ফিরেও আসছেন। কিন্তু সংক্রামিত এবং সুস্থ হয়ে ফিরে আসা, দুটির মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, একজন সংক্রামিত হলে ১০-১২ জনকে কোয়ারান্টিনে পাঠানোর ফলে সমস্যা বেশি হচ্ছে। তবে, ইন্ডিযান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) যদি এমন কোনও নির্দেশিকা জারি করে য়ে, চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীরা করোনায় সংক্রামিত হলে যাঁদের শরীরে উপসর্গ নেই তাঁদের দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা চালু রাখা যাবে, তাহলে সমস্যা কিছুটা মিটবে।
তবে, এটা শুধু উত্তরবঙ্গ মেডিকেল বা রাজ্যের বিষয় নয়, গোটা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলিতেই একই অবস্থা হচ্ছে। ওএসডি ডাঃ সুশান্ত রায় অবশ্য বলেন, চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসাকর্মীদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় টিমও তৈরি করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা পরিষেবা দিতে কোনও সমস্যা হবে না। মেডিকেল সুপার ডাঃ কৌশিক সমাজদার বলেন, আমাদের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা যেভাবে সংক্রামিত হচ্ছেন তাতে আমরাও চিন্তিত। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই মেডিকেলে ভর্তি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। আবার সমস্ত রোগীকেই ভর্তি রেখে চিকিৎসা করা হচ্ছে। এভাবে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়লে ১০-১২ দিন পরে সত্যিই পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।