কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

বস্তি এলাকায় করোনা প্রতিরোধে তৎপর কলকাতা পুরসভা

June 14, 2020 | 3 min read

করোনা প্রতিরোধে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কতটা কার্যকর, তা নিয়ে এখনও বিশ্বের চিকিৎসক মহল পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ ভারত থেকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন আমদানি করলেও করোনায় মানুষের মৃত্যু মিছিল ঠেকাতে সফল হয়নি। কিন্তু সেই ওষুধ প্রয়োগ করে মূলত শহরের বস্তি এলাকায় করোনা সংক্রমণ বেশ কিছুটা ঠেকানো গিয়েছে বলে দাবি করল কলকাতা পুরসভা।

করোনা প্রতিরোধে কলকাতা পুরসভা শহরের প্রতিটি বস্তিতে বিনামূল্যে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বিলি করছে। পুরসভার যে সব কর্মী ও অফিসার করোনা প্রতিরোধে সরাসরি যুক্ত বা একেবারে সামনে থেকে কাজ করছেন, সেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাইকর্মীদেরও প্রত্যেককে নির্দিষ্ট ডোজে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ানো হচ্ছে। পুরসভার হিসেব অনুযায়ী, তাদের তরফে ১১ জুন পর্যন্ত কলকাতা পুর এলাকায় মোট ৮৩ হাজার ৫৬ জনকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ানো হয়েছে। এর মধ্যে পুরকর্মীরা বাদ দিলে বাকিরা সবাই মূলত বস্তি এলাকার বাসিন্দা।

কলকাতা পুরসভার করোনা বিষয়ক অ্যাডভাইসরি কমিটির অন্যতম সদস্য, তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন জানাচ্ছেন, তিনিই প্রথম নিজের উদ্যোগে বেলগাছিয়া বস্তিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট বিলি করেন। যাঁদের হাল্কা জ্বর, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, তাঁদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট খাওয়ানো হচ্ছে। শান্তনুর পরামর্শ মেনে পরবর্তী সময়ে শহরের অন্যান্য বস্তিতে নির্দিষ্ট মাত্রায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া শুরু করে কলকাতা পুরসভা। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ডোজ অবশ্য পুরসভা বেধে দিয়েছে। প্রথম দিন ৪০০ মিলিগ্রাম করে দু’টো ট্যাবলেট খেতে বলা হচ্ছে। এর পর সপ্তাহে একটা করে ট্যাবলেট। টানা পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহ এই ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে পুরসভা।

কলকাতা পুরসভার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত ১০-১২ দিনে শহরের কোনও বস্তি এলাকা থেকে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর মেলেনি। মার্চ-এপ্রিল মাসে বেলগাছিয়া বস্তিতে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর পর চিন্তায় পড়েছিলেন পুরসভার অনেকে। কারণ, ওটাই কলকাতার সব চেয়ে বড় বস্তি। তার উপর ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। শুরুতেই ওই বস্তির মোট ১৪ জনের করোনা-পজিটিভ ধরা পড়ে। তার মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু পুরসভার বক্তব্য, ১৫ এপ্রিলের পর থেকে বেলগাছিয়া বস্তিতে আর কেউ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হননি।

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকায় একাধিক বড় বস্তি রয়েছে। সেখানে প্রচুর সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ঘর ভাড়া করে থাকেন। বন্দর থাকায় বাইরের লোকজনেরও নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। করোনা প্রতিরোধের কাজে যুক্ত কলকাতা পুরসভার আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, দিন ১০-১২ আগেও কলকাতা বন্দর এলাকায় যত করোনা-আক্রান্তের খবর পাওয়া যেত, তাঁদের মধ্যে ৯০-৯৫ শতাংশ বস্তির বাসিন্দা। কিন্তু সেই ছবিটা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এখন যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের ৯৫-৯৮ শতাংশই থাকেন ফ্ল্যাটে অথবা আলাদা বাড়িতে। তপসিয়া, তিলজলা, হাতিবাগান, উল্টোডাঙা, শিয়ালদহ, রাজাবাজারে যে সব বড় বস্তি রয়েছে, সেখান থেকেও নতুন করে করোনা-আক্রান্তের খবর নেই বলে পুরসভার বক্তব্য।

কলকাতার বস্তি এলাকা

ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি শান্তনু সেনের মতে, ‘বস্তির বাসিন্দারা আমাদের কথা মতো হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেয়েছেন। সেই জন্যই বস্তিতে করোনা সংক্রমণ এক জায়গায় এসে আটকে গিয়েছে। নতুন করে বস্তিতে করোনা ছড়াচ্ছে না। কিন্তু ফ্ল্যাট ও আলাদা বাড়ির বহু বাসিন্দা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়া তো দূরের কথা, পুরকর্মীদের বাড়িতেই ঢুকতে দিচ্ছেন না। সেই জন্য এই শ্রেণির লোকের মধ্যে করোনার প্রকোপ বাড়ছে।’

কলকাতা পুরসভার প্রশাসনিক বোর্ডের সদস্য, স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতীন ঘোষ বলেন, ‘বস্তিতে বস্তিতে পুরসভার উদ্যোগে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রতি সপ্তাহে স্যানিটাইজেশনের কাজও হচ্ছে। লকডাউন কঠোর ভাবে কার্যকর করতে বস্তির বাসিন্দারা নিজেরাই ব্যারিকেড তৈরি করে বহিরাগতদের আসা আটকেছেন। সব মিলিয়ে বস্তি এলাকায় করোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।’

ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেল্‌থের চিকিৎসক প্রভাস প্রসূন গিরির ব্যাখ্যা, আইসিএমআর-এর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, যে সব স্বাস্থ্যকর্মী করোনার বিরুদ্ধে সামনে থেকে লড়াই করছেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেলে তাঁদের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে যাচ্ছে।’ তাঁর কথায়, ‘করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের ও যাঁরা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ানো যেতে পারে। ভারতের বাইরে বহু দেশে এখনও পর্যন্ত যত সমীক্ষা রিপোর্ট সামনে এসেছে, তাতেও দেখা গিয়েছে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করলে সংক্রমণের হার কমে। কিন্তু গণহারে সবাইকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ানোর সুপারিশ এখনও পর্যন্ত কেউ করেননি।’ ওই চিকিৎসক বলেন, ‘শুধু হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাইয়ে বস্তিতে করোনার সংক্রমণ বন্ধ হয়েছে কি না, সেটা এখনই বলা যাবে না। সেই জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার।’ ফার্মাকোলজি-বিশেষজ্ঞ স্বপনকুমার জানা বলেন, ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কতটা কার্যকর প্রতিরোধক, তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তাই, কলকাতায় সেই ওষুধ প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে কি না, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা মুশকিল। যদি সুফল মেলে, তা হলে তো ভালোই।’

তথ্য সৌজন্যেঃ- তাপস প্রামাণিক, এই সময়

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#KMC, #slum area, #covid-19

আরো দেখুন