সাহায্যই কাটাতে পারে মনের অবসাদ
করোনা সংক্রমণ, লকডাউন, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব যে দেশবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে, তা বারবারই উঠে আসছিল মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কথায়। প্রভাব কতটা বড়, তা ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি সোসাইটির এক অনলাইন সমীক্ষায় প্রকাশ্যে এল। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশে প্রায় চার গুণ বেড়েছে উদ্বেগ, অবসাদের হার। ১০-১০.৫ শতাংশের আশেপাশে থাকা দেশবাসীর উদ্বেগ এবং অবসাদের হার গিয়ে পৌঁছেছে ৪০.৫ শতাংশে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ‘করোনাকে ভয় না পেয়ে বাস্তবকে স্বীকার করুন। তথ্যের বোঝায় চাপা না পড়ে নজর দিন জীবনের অন্য চাহিদার দিকে। প্রয়োজনে সাহায্য চান। সাহায্যের হাত বাড়ান।’
লকডাউনের প্রভাব ঠিক কতটা গভীর হচ্ছে দেশবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যে? সেটা বোঝার জন্যই এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশজোড়া অনলাইন সমীক্ষা শুরু করেন ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি সোসাইটির একদল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ইংরেজি ছাড়াও ১১টি আঞ্চলিক ভাষায় তৈরি নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। একটি ডিভাইস থেকে যাতে একবারই মাত্র উত্তর দেওয়া যায়, করা হয় সে ব্যবস্থাও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১৮৭১ জন (১৪-৮৭ বছর বয়সি)। যার মধ্যে ১৬৮৫ জনের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা হয়।
দেখা যায়, শতকরা ৩৮.২% মানুষ উদ্বেগের শিকার। আর ডিপ্রেশন রয়েছে ১০.৫ শতাংশের। সবমিলিয়ে ৪০.৫% মানুষ যুগপত উদ্বেগ এবং অবসাদের শিকার। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭৪.১% মানুষ মাঝারি মানের স্ট্রেসে ভুগছেন বলেও জানা গিয়েছে স্টাডি পেপারে। ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি সোসাইটির রিসার্চ, এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং সাব কমিটির চেয়ারম্যান, পিজিআই চণ্ডীগড়ের মনোরোগ বিভাগের প্রধান অজিত অবস্থি বলেন, ‘শুধু করোনা বা লকডাউন নয়। মানুষের মনে সার্বিক একটা অনিশ্চয়তা থেকেই এই উদ্বেগ এবং অবসাদের বৃদ্ধি ঘটেছে বলে মনে করছি আমরা।’ গবেষক দলের অন্যতম সদস্য এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের শিক্ষক চিকিৎসক ওমপ্রকাশ সিং বলছেন, ‘স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং অবসাদ চারগুণ বেড়েছে, যেটা চিন্তার বটেই। এই স্টাডি আমাদের মনে করাচ্ছে, মনের সমস্যাকেও শরীরের অন্য সমস্যার মতোই সমান গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।’
সমাধানের উপায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বেগ অবসাদের এই পর্যায় অনেক মানুষই পেরিয়ে আসবেন, জনজীবন স্বাভাবিক হলেই। যাঁরা পারবেন না, তাঁদের জন্য ফর্টিস হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব গর্গের পরামর্শ, ‘করোনা নিয়ে ভয় কাটানোটা সবচেয়ে জরুরি। করোনা আমাদের সঙ্গে থাকবে, এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যাবে, তত দ্রুত জীবনের অন্য দিকগুলোয় আমরা মন সংযোগ করতে পারব। তবে একই সঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার, নিজের সুরক্ষার সঙ্গে আপস করলে চলবে না। করোনাকে নিয়ে চলাটাই এখন নিউ-নর্মাল।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুধু এটুকু করলেই হবে না, ভালো থাকার জন্য সোশ্যাল নেটাওয়ার্কিং সাইটের ‘তথ্য-বন্যা’র স্রোত থেকেও নিজেকে আলাদা করা অত্যন্ত জরুরি। ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি সোসাইটির সুইসাইড প্রিভেনশন সেলের কনভেনর এবং ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির শিক্ষক চিকিৎসক সুজিত সরখেল বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে আসা তথ্যকেই বিশ্বাস করতে হবে। না হলে এত তথ্যের (কিছু সঠিক, কিছু ভুল) চাপে অনেক সময়েই উদ্বেগ বাড়তে থাকে। মনে হয়, আমি হয়তো পরবর্তী শিকার। এই তথ্যের চাপ না কমালে উদ্বেগ কমবে না।’
ডিপ্রেশনের মোকাবিলা হবে কী ভাবে? ওমপ্রকাশ বলছেন, ‘আমি ভালো নেই এটা বুঝতে পারলেই সাহায্য চাইতে হবে। কাছের কেউ সমস্যায় আছে বুঝলে তাঁকে সাহায্য করতে এগোতে হবে।’