ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের জের, রাজ্যে ল্যাপটপের বিক্রি দ্বিগুণ
প্রথম পর্বের আনলকডাউন শুরু হলেও ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম অব্যাহত। রাজ্য সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে, জুলাইতেও স্কুল, কলেজ খুলবে না। ফলে, অনলাইন ক্লাসই ভরসা। এই ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বিপুল বেড়ে গিয়েছে ল্যাপটপের চাহিদা। বিশেষ করে বিক্রি বেড়েছে ৩০,০০০-৩৫,০০০ টাকা দামের ল্যাপটপের। করোনা-লকডাউনের আগে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে মাসে এই দামের ল্যাপটপ বিক্রি হতো ৬,০০০-এর মতো, বর্তমানে সেটা তিনগুণ বেড়ে প্রায় ১৮,০০০ হয়েছে।
ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম, অনলাইন ক্লাস ভবিষ্যতেরও ভবিতব্য। এটা ধরে নিয়েই কম্পিউটার তৈরির সংস্থাগুলি এই সেগমেন্টকে পাখির চোখ করে একের পর এক নয়া মডেল নিয়ে আসছে। ল্যাপটপের বাক্সে মাইক্রোসফ্ট লোগোর তলায় ‘ইনক্লুডস্ অফিস হোম অ্যান্ড স্টুডেন্ট, ডোন্ট ফরগেট টু অ্যাক্টিভেট’। মাইক্রোসফ্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে অনেকে ৩২,০০০ টাকা দামের ল্যাপটপেই প্রি-ইনস্টলড উইন্ডোজ-১০ অপারেটিং সিস্টেম এবং লাইফটাইম মাইক্রোসফ্ট অফিস সফটওয়্যার দিচ্ছে।
কলেজ পড়ুয়া, বিশেষ করে, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে ৪৫,০০০-৫০,০০০ টাকা দামের মধ্যে এন্ট্রি-লেভেল গেমিং ল্যাপটপও নিয়ে এসেছে সংস্থাগুলি। বিক্রিও বাড়ছে। এই ধরনের ল্যাপটপের স্পেসিফিকেশন অপেক্ষাকৃত উন্নত থাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন বা গ্রাফিক্সের কাজ করা সম্ভব।
বর্তমানে বিক্রির নিরিখে ভারতের ল্যাপটপ বাজারের প্রথম পাঁচে রয়েছে যথাক্রমে এইচপি, লেনোভো, ডেল, এসার ও আসুস। এই পাঁচটি সংস্থারই কলকাতার ডিস্ট্রিবিউটর গ্যালাক্সি কম্পিউটেক-এর ডিরেক্টর নরেন্দ্র ধানুকা বলেন, ‘লকডাউনের আগে গোটা রাজ্যে মাসে ১৫,০০০-এর মতো ল্যাপটপ বিক্রি হতো, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৩০,০০০। বিক্রি সবথেকে বেশি ৩০,০০০-৩৫,০০০ টাকা দামের মডেলের। এই সেগমেন্টেই গত এক মাসে ১৮,০০০ ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে, যা লকডাউনের আগে ৬,০০০ ছিল। এই দামের সেগমেন্টে পাঁচটি সংস্থা মিলিয়ে অন্তত ১৫টি মডেল রয়েছে। কিন্তু, মডেলগুলির যা চাহিদা, সেই তুলনায় সরবরাহ অত্যন্ত কম।’ তাঁর মতে, আগামী তিন বছরে ৩০,০০০-৪৫,০০০ টাকা দামের সেগমেন্টে সবথেকে বেশি ল্যাপটপ বিক্রি হবে।
অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ল্যাপটপ তৈরির সংস্থার আধিকারিক বলেন, ‘একদিকে বাচ্চাদের স্কুলের অনলাইন ক্লাস চলার শাপাশি বাড়ি থেকেই অফিস-ব্যবসার কাজ করতে হচ্ছে। ফলে, বাড়িতে প্রি-ইনস্টলড উইন্ডোজ- ১০ অপারেটিং সিস্টেম এবং লাইফটাইম মাইক্রোসফ্ট অফিস থাকা একটি ল্যাপটপ কিনলে দুটো উদ্দেশ্যই পূরণ করা সম্ভব এবং একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট। শুধু প্লাগ অ্যান্ড প্লে। সেই কারণেই ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা দামের মধ্যে হাল্কা ওজনের ল্যাপটপের চাহিদা হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে।’ তিনি জানান, বর্তমানে বিক্রির যা গতিপ্রকৃতি সেটা বজায় থাকলে জুলাই থেকে ভারতে দৈনিক ল্যাপটপের বিক্রি গত বছরের থেকে অনেক বেড়ে যাবে।
দামের দিক থেকে ভারতে ল্যাপটপের বাজারের তিনটি সেগমেন্ট। প্রথমটি ৩০,০০০ টাকা দামের মধ্যে এন্ট্রি-লেভেল সেগমেন্ট। মিড বা মেইনস্ট্রিম সেগমেন্টের দাম ৩০,০০০-৫২,০০০ টাকা এবং তার থেকে বেশি দামের প্রিমিয়াম সেগমেন্ট। বর্তমানে ল্যাপটপ বাজারের অর্ধেক এন্ট্রি-লেভেল সেগমেন্টের দখলে। প্রিমিয়াম সেগমেন্টের অংশীদারিত্ব ১৫ শতাংশ এবং বাকিটা মিড সেগমেন্টের দখলে। ‘নিউ নর্মাল’ পরিস্থিতিতে মিড সেগমেন্টের অংশীদারিত্ব বেড়ে অন্তত ৫০ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কলকাতার প্রথম সারির কম্পিউটার বিপণি টেকনোক্র্যাট ইনফোটেক-এর ডিরেক্টর আসিফ খান বলেন, ‘আমার হিসাবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মিড সেগমেন্টের দখলে ল্যাপটপের ৭০ শতাংশ বাজার চলে আসবে। কমবে এন্ট্রি-লেভেল সেগমেন্টের বিক্রি। কারণ, এন্ট্রি-লেভেল সেগমেন্টে ২৮,০০০-২৯,০০০ টাকা দামের ডস অপারেটিং সিস্টেমের ল্যাপটপ কিনে তাতে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ও মাইক্রোসফ্ট অফিস আলাদা করে কিনে ইনস্টল করতে অতিরিক্ত ৯,০০০-১০,০০০ টাকা খরচ পড়ে। সেখানে ২,০০০-৩,০০০ টাকা বেশি দাম দিলেই ক্রেতারা এখন প্রি-ইনস্টলড উইন্ডোজ-১০ অপারেটিং সিস্টেম এবং লাইফটাইম মাইক্রোসফ্ট অফিস সহ ল্যাপটপ পাচ্ছেন।’
ল্যাপটপে অরিজিন্যাল উইন্ডোজ- ১০ ও লাইফটাইম মাইক্রোসফ্ট অফিস ৩০,০০০-৩৫,০০০ টাকা দামের মধ্যেই পাওয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে স্কুল পড়ুয়াদের কথা ভেবে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কনটেন্টও ওই দামের ল্যাপটপগুলিতে প্রি-ইনস্টলড অবস্থায় আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। স্টার্ট-আপ মেন্টর কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতে এডুকেশনাল বা শিক্ষামূলক কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে এমন বড়, ছোট থেকে সদ্যোজাত সংস্থা অসংখ্য। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেক বড় স্কুল গোষ্ঠীই এধরনের সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যিক গাঁটছড়া বেঁধে একেবারে কাস্টোমাইজড মাল্টি-মিডিয়া কনটেন্ট নিয়ে আসছে। সেটা হলেই ল্যাপটপ তৈরির সংস্থাগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্কুল গোষ্ঠী ও কনটেন্ট প্রস্তুতকারী সংস্থার গাঁটছড়া হতে বাধ্য। অচিরেই এমন দিন আসবে যখন স্কুলই তাদের ছাত্রছাত্রীদের বলে দেবে কোন সংস্থার কী মডেলের ল্যাপটপ কিনতে হবে বা তারাই ওই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও মডেলের ল্যাপটপ সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের বিক্রি করবে।’ ফলে, স্কুল ব্যাগের বোঝা সংক্রান্ত দুশ্চিন্তাও এই সূত্রে কিছুটা লাঘব হবে।
এইচপি ইন্ডিয়ার সিনিয়র ডিরেক্টর, পার্সোনাল সিস্টেম, বিক্রম বেদীর মন্তব্য, ‘স্কুল ও কলেজে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, তাই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আমরা ল্যাপটপের বিপুল চাহিদা পাচ্ছি। এই সেগমেন্টের ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন হাই-পারফরম্যান্স কম্পিউটার, দীর্ঘমেয়াদি ব্যাটারি, আধুনিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রি-ইনস্টলড সলিউসনস। ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভেবে আমরা আবার ব্যাক-টু-কলেজ প্রোগ্রাম নিয়ে আসছি, যাতে ক্রেতারা বিভিন্ন সুবিধা পাবেন।’
শুধু অফলাইন নয়, অনলাইনেও ল্যাপটপের চাহিদা বেড়েছে। ফ্লিপকার্টের এক মুখপাত্র জানান, গেমিং ল্যাপটপ ও কোর আই৩ ল্যাপটপের চাহিদা অনেক রাজ্যে বেড়েছে। সংস্থাটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘নো কস্ট ইএমআই’-তে ল্যাপটপ কেনার সুযোগও দিচ্ছে।