সুন্দরবনকে ৯.৫ লাখ টাকা সাহায্য আর এক প্রবাসী বাঙালির
দূরত্ব কম করে ১৩ হাজার কিলোমিটার। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কুলতলি। কিন্তু সেই দূরত্ব ঘুচে গিয়েছে এক লহমায়। কুলতলি-সহ আম্পান-বিধ্বস্ত সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার বিপন্ন বাঙালিদের হাতে সহমর্মিতার হাত রেখেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রবাসী বাঙালিরা। তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়া কেন! মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন জায়গার সব মিলিয়ে দেড়শোর বেশি প্রবাসী বাঙালি তুলে দিয়েছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ডলার অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা। যা থেকে আসছে নদীবাঁধ পুনর্নির্মাণের কাজে যুক্ত মানুষদের রোজকার চাল-আলু-পেঁয়াজ দেওয়া এবং কমিউনিটি কিচেন ও মেডিক্যাল ক্যাম্প চালানোর খরচের কিছুটা।
মেরিল্যান্ড থেকে মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কানেকটিকাট, অনাবাসী বাঙালিদের এই কাজে এক সূত্রে গেঁথেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার এক বাঙালি দম্পতি। সংযুক্তা সামন্ত ও অরিন্দম সামন্ত। দেড় দশক আগে সল্টলেক থেকে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দিয়েছিলেন ওই দম্পতি। তাঁরা থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির কুপারটিনো শহরে। দু’জনেই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। বাংলায়, বিশেষ করে সুন্দরবনে আম্পানের ধ্বংসলীলার ছবি দুই সন্তানের অভিভাবক ওই দম্পতিকে নাড়িয়ে দেয়। অরিন্দম ও সংযুক্তার মনে হয়, তাঁদের তরফে অবশ্যই কিছু করা প্রয়োজন। ‘কিন্তু তার পরেই মনে হল, ধ্বংসের যা বহর, তাতে শুধু আমাদের দু’জনের করাটা যথেষ্ট নয়। আরও অনেককে সামিল করতে হবে,’ কুপারটিনো থেকে সোমবার ফোনে বললেন সংযুক্তা।
মার্কিন মুলুকের প্রবাসী বাঙালি বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ শুরু করলেন ওই দম্পতি। একই সঙ্গে খোঁজ শুরু হল ফেসবুকে অর্থ সংগ্রাহক বা ফান্ডরেজার হিসেবে রেজিস্টার্ড একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার, যাদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো সহজ হবে। তাঁরা পেলেন ‘কলকাতা ফাউন্ডেশন’-কে। ফেসবুকে তৈরি হল ক্রাউডফান্ডিং পেজ বা গণ তহবিল সংগ্রহের আলাদা পাতা। সপ্তাহান্তের ছুটি কাজে লাগিয়ে ফোনে বা সামাজিক মাধ্যমে চেনাজানা প্রত্যেককে সরাসরি আবেদন জানালেন ওই দম্পতি। অরিন্দম বিষয়টা জানাতেই স্যারাটোগা শহরের রোমিতা দে বলেছিলেন, ‘আম্পানের ক্ষয়ক্ষতির কথা শুনে কেঁপে গিয়েছিলাম। কলকাতার বাড়িতে আমার মা-বাবার দেখাশোনা করেন যাঁরা, তাঁদের বাড়ি সুন্দরবনে। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রত্যেকেরই বাড়ি উড়ে গিয়েছে। বুঝতে পারছিলাম না, কী ভাবে সাহায্য করব। এখন তুমি রাস্তা বাতলে দিলে।’
সাহায্য ঢুকল হইহই করে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া, অ্যারিজোনা, টেক্সাস-সহ আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে। সংযুক্তা ও অরিন্দমের কথায়, ‘আমাদের প্রথমে লক্ষ্য ছিল ১ হাজার ডলার সংগ্রহ করা। কিন্তু ২৯ মে থেকে ১ জুন, এই চার দিনের মধ্যে ১০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেল!’
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা বলছেন, ‘এই ধরনের সাহায্যে প্রশাসনের কাজটা সহজ হয়ে যায়। ওই দম্পতি শিকড়কে ভোলেননি। নিজেরা শুধু সাহায্য দেননি, অন্য শতাধিক মানুষের কাছ থেকে সাহায্য জোগাড় করে পাঠিয়েছেন। এবং সেটা করেছেন আমেরিকায় ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও।’
যাদের মাধ্যমে মার্কিন মুলুক থেকে প্রবাসী বাঙালিদের সাহায্য এসেছে, সেই ‘কলকাতা ফাউন্ডেশন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, নিউ জার্সির ধৃতিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘অরিন্দম ও সংযুক্তা হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও সুন্দরবনে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের কথা ভেবে যা করলেন, তার জন্য কোনও বিশেষণ যথেষ্ট নয়।’ তাঁদের সহযোগী সংস্থা ‘মুক্তি’ গত ১৫ বছর ধরে সুন্দরবনের উন্নয়নে কাজ করছে। ওই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, শঙ্কর হালদার বলেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ার প্রবাসী বাঙালি দম্পতির উদ্যোগে সাড়ে ৯ লক্ষ টাকার যে ফান্ড এসেছে, তা দিয়ে বাঁধ পুনর্নির্মাণের কাজে সামিল মানুষদের কাজের বিনিময়ে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। চলছে ২০০টি কমিউনিটি কিচেন। যেখানে রোজ ৬ হাজার মানুষ খাচ্ছেন। তা ছাড়া, আমরা পাঁচটি ব্লকে মেডিক্যাল ক্যাম্পও চালু করেছি।’
সোমবারই মথুরাপুর-২ নম্বর ব্লকের পূর্ব শ্রীধরপুরের গ্রামের সরমা পাইক, কুলতলির বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের কার্তিক দাস বাঁধের কাজ করে তার বিনিময়ে ২ কেজি করে চাল এবং ১ কেজি করে আলু ও পেঁয়াজ পেয়েছেন। মথুরাপুর-২ নম্বর ব্লকের বরদানগর গ্রামের গফুর মোল্লার সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ। বদহজমেও ভুগছেন তিনি। এ দিন মেডিক্যাল ক্যাম্পে তাঁকে চিকিৎসক দেখে ওষুধ দিয়েছেন।
ওঁরা কেউই জানেন না, এ সবের পিছনে কিছুটা অবদান আছে, ওঁদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরের প্রবাসে থাকা দেড় শতাধিক বাঙালির!