পুর পরিষেবায় ভালো কাজ করেও বাংলাকে স্বীকৃতি দিল না কেন্দ্র
পুর পরিষেবার কর্মদক্ষতা বা পারফরম্যান্সের নিরিখে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সামনের সারিতে। এটা শুধু রাজ্য সরকারের দাবি নয়, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের মূল্যায়ন-রিপোর্টেও সে কথা বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও গত তিন বছর ধরে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মতো পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় সাহায্য পাচ্ছে না বলে রাজ্য সরকার জানিয়েছে। এই খাতে কেন্দ্রীয় সাহায্যের বকেয়ার পরিমাণ এখনও পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৫৮৮ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে পারফরম্যান্স গ্রান্টের পরিমাণই ১১৪০ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। নবান্নের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে রাজ্যের ওই প্রাপ্য টাকার জন্য একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার পরেও কোনও লাভ হয়নি।
চতুদর্শ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মতো, ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছর থেকে ওই অনুদান পাওয়ার কথা। প্রথম বছর ১৯টি রাজ্যকে তা দেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ এক টাকাও পায়নি। অথচ সেই আর্থিক বছরে পুর পরিষেবা দেওয়ার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে। তার পরেও পশ্চিমবঙ্গ ‘র্যাঙ্কিংয়ে’ বরাবর প্রথম দিকে থেকে থেকেছে। পরবর্তী দু’বছর আবার এই অনুদান দেওয়াই বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুদান কেন দেওয়া হচ্ছে না, তা সরকারি ভাবে নবান্নকে নর্থ ব্লক জানায়নি।
কিন্তু কেন এই অনুদানের টাকা রাজ্যকে দিচ্ছে না কেন্দ্র?
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাজনৈতিক কারণে এই রাজ্যকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সাহায্য করছে না। পুর পরিষেবার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের পারফরম্যান্স ভালো। সেটা শুধু আমরা না, কেন্দ্রও বলছে। কিন্তু পুর পরিষেবা দেওয়ায় বহু বিজেপি-শাসিত রাজ্যের পারফরম্যান্স ভালো নয়।’ ফিরহাদের মতে, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আর্থিক ভাবে চাপে রাখতেই চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ না-মেনে পশ্চিমবঙ্গের পুর পরিষেবার পারফরম্যান্স-গ্রান্টের টাকা নানা কৌশলে কেন্দ্র আটকে রেখেছে। এটা পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা।’
পুর পরিষেবা দেওয়ার পারফরম্যান্সের বিচার কীসের ভিত্তিতে হয়?
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর সূত্রের খবর, পুরসভা নিজের রাজস্ব আদায় বাড়াচ্ছে কি না, বাড়ালে কতটা বাড়াচ্ছে, পুরসভাগুলো তাদের নিজস্ব আয় থেকে রোজকার খরচ তুলতে পারছে কি না, পুর এলাকার উন্নয়নে নিজস্ব আয় থেকে কিছুটা হলেও উন্নয়ন প্রকল্পে মূলধনী বিনিয়োগ করতে পারছে কি না, এ সব দেখা হয়। এবং পুরসভার এই রাজস্ব বৃদ্ধি ও তা থেকে খরচের প্রতিফলন অবশ্যই পুরসভার অডিট রিপোর্ট থাকতে হবে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে সেই অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে পুরসভাকে। নাগরিকদের সেই ব্যাপারে অবগত করতে হবে। পুরসভা নাগরিকদের জন্য কী কী বেসিক বা ন্যূনতম পরিষেবার বন্দোবস্ত করেছে, তা নিয়ম করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। রাজ্য সরকারের দাবি তো আছেই, সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের নথিও বলছে, এ সব ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পারফরম্যান্স বেশ ভালো।
তা হলে কেন্দ্রীয় সাহায্য পেতে সমস্যাটা কোথায়?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের বক্তব্য, বিজেপি অথবা বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার যেখানে যেখানে রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজ্যে পুর পরিষেবার মান ভালো নয়। ওই সব রাজ্যের বহু শহরে অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুর শংসাপত্র নেওয়ার পরিষেবাই শুরু হয়নি। আবার বিজেপি শাসিত কোনও কোনও রাজ্যে তা চালু হলেও বিভিন্ন ত্রুটির কারণে মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের তথ্য থেকেই জানা যাচ্ছে, সেই সব রাজ্যের বহু শহর নামেই স্মার্ট সিটি হয়েছে। সেখানে পুরকর বেড়েছে, অথচ পরিষেবার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি ।
দেশ জুড়ে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে চতুর্দশ অর্থ কমিশন ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পুরসভাগুলোকে ৮৭ হাজার ১৩২ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সুপারিশে বলা ছিল, ওই টাকার ৮০ শতাংশ মূল অনুদান হিসেবে দিতে হবে, বাকি ২০ শতাংশ দেওয়া হবে পারফরম্যান্সের নিরিখে। ’১৭-১৮ অর্থবর্ষ থেকে পারফরম্যান্স গ্রান্ট দেওয়ার কথা বলা হয়।
কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের বেঁধে দেওয়া মাপকাঠির নিরিখে হরিয়ানা, অসম, ত্রিপুরা-সহ একাধিক বিজেপি-শাসিত রাজ্য ডাহা ফেল করেছে। সেই তুলনায় বিজেপি ক্ষমতায় নেই, এমন কয়েকটি রাজ্যের পারফরম্যান্স ভালো।