ইন্দিরা গান্ধী, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং জরুরী অবস্থা
১৯৭৫ সালের ২৫জুন গভীর রাতে জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার পরের দিন ২৬ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কন্ঠে বেজে ওঠে ‘‘অযথা আতঙ্কিত হবেন না৷ রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা জারি করেছেন৷’’
আগের রাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদকে দিয়ে জরুরী অবস্থার নির্দেশনামা সাক্ষর করান ইন্দিরা৷ রেডিওতে তাঁর ওই ঘোষণার আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যেরই জানা ছিল না দেশে এমন ঘটনা ঘটতে হচ্ছে৷
ভারতীয় সংবিধানে থাকা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার যুক্তি দেখিয়ে জরুরী অবস্থার বিধান সম্পর্কে জানতেন না তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তখনকার প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের পরামর্শেই জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন তিনি।
জরুরী অবস্থা জারির পাশাপাশি দিল্লির সংবাদপত্রগুলির ছাপাখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে সংবাদপত্র ছাপতে না পারে তারপরের দুদিন৷ এদিকে বহু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতারা এর বিরোধিতা করায় তাদের গ্রেফতার করা হয়৷
২১ মাস ধরে চলা এই জরুরী অবস্থা আধুনিক ভারতের ইতিহাসে কালো দিন ৷ দেশের অভ্যন্তরীণ অশান্তি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য এই জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে বলে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল৷ আর তারফলে বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো সাংবিধানির অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়৷ ইন্দিরা গান্ধী দাবী করেছিলেন, ওই সময় জাতীয় স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত৷
এই ঘটনার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণঃ
প্রথমত, গুজরাতে নবনির্বাণ আন্দোলন৷ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে আহমেদাবাদের এলডি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রেরা ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘট করে৷ এক মাস পরেই গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়৷ যা নবনির্বাণ আন্দোলন নামে পরিচিত৷ এমন পরস্থিতিতে সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়৷
দ্বিতীয়ত, গুজরাতের ঘটনা যেন অনুপ্রাণিত হয়ে এমন আন্দোলনে দানা বাধে বিহারেও৷ ছাত্রেরা আন্দোলন শুরু করলে দ্রুত বিহারে বর্ষীয়ান নেতা তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ৭১ বছরের জয়প্রকাশ নারায়ণের (জেপি) নেতৃত্ব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিহার৷ তবে গুজরাতের মতো বিহারে রাষ্ট্রপতি শাসন যেতে চাননি ইন্দিরা গান্ধী৷ দেশময় জয়প্রকাশের আন্দোলনের প্রভাব দেখেই ইন্দিরাকে ঠেলে দিয়েছিল জরুরী অবস্থা জারি করার দিকে৷
চারপাশের বিরোধী দল, ছাত্র শ্রমিক ইউনিয়নের বিক্ষোভের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সময় দুশ্চিয়তায় ফেলে দিয়েছিল সোসালিস্ট নেতা রাজনারায়ণ৷ ১৯৭১ সালে রায়বেবেলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ইন্দিরার জয় হয়েছিল মামলা করেছিলেন৷ দেশের সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল। মূলত এই রায়ে রাজনারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৬ বৎসর সংসদীয় রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিলেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা যেত৷ ফলে সুপ্রিম কোর্ট আবেদন করায় ২৪ জুন এই রায়ের সাপেক্ষে শর্ত সাপেক্ষে স্থগিতাদেশ দেয়৷ তিনি সংসদে যেতে পারবেন তবে কোনও বিষয়ে তখন ভোট দিতে পারবেন না৷ সেই সময় অবশ্য অনেক কংগ্রেস নেতাই চেয়েছিলেন ইন্দিরা পদত্যাগ করুন৷ কিন্তু সে পথে না গিয়ে পরের দিন অর্ডিন্যান্স খসড়া করে জরুরী অবস্থা জারি করার দিকে এগিয়ে যান প্রিয়দর্শনী৷