দেবী চৌধুরানীর মন্দির – ইতিহাসের অদম্য সাক্ষী
ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী, এই নাম দু’টোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস। উত্তরবঙ্গে, বিশেষত তিস্তা নদী ঘেরা জলপাইগুড়ির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা কালীমন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই দু’টি ঐতিহাসিক নাম। এরকমই এক ইতিহাসের সাক্ষী সন্ন্যাসী ঠাকুরের মন্দির।
জলপাইগুড়ির শিকারপুর গ্রামে চা বাগান ঘেরা এই মন্দিরকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা কথা। শিকারপুর চা বাগানের মধ্যেই এই মন্দির। গেট দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে পাশাপাশি দু’টি মন্দির। তার মধ্যে একটি মা কালীর। এখানে বছরে দু’বার কালীপুজো হয়। একবার আষাঢ় মাসে, আর একবার এই কার্তিক মাসে। খুব বড় করে না হলেও নিয়মনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই পুজো সম্পন্ন হয়।
সারা বছর পুজোর জন্য একজন রাজবংশী পুরোহিত থাকলেও আষাঢ় ও কার্তিক মাসের পুজো করেন এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী এখানে এখনও ছাগল ও পায়রা বলির প্রচলন আছে। চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেরাই চাঁদা তুলে পুজোর আয়োজন করেন। দীপাবলির রাতের পুজোয় শুধু গ্রামবাসী নয়, ভিড় জমান অনেক দূরের গ্রাম থেকে আসা মানুষও। রাতভর চলে পুজো। এলাকায় জমজমাট মেলা বসে। পুজো শেষে ভোরবেলায় মায়ের ভোগ নিয়ে সকলে ফিরে যান।
কালীমন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি প্যাগোডা ধাঁচে তৈরী আরেকটি মন্দির। সারা বছর পুজো হয় এই মন্দিরেও। তবে এখানকার বিগ্রহ নিয়ে নানা মতান্তর রয়েছে। এই মন্দিরে একটি পুরুষ ও একটি নারী মুর্তি রয়েছে। পাশাপাশি বাঘ, শেয়াল ও আরও কিছু বিগ্রহ আছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি শিব-পার্বতীর মন্দির।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবী অবশ্য প্রধান বিগ্রহ দু’টি ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর। এই দাবীর সমর্থনে কিছু ঐতিহাসিক লিখেছেন, বৈকুন্ঠপুর রাজবংশের এক বংশধর দর্পদেব রায়কত ১৭২৮ থেকে ১৭৯৩ সাল অবধি রাজত্ব করার সময় ভবানী পাঠক নামে এক সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসেন। রাজা দর্পদেবের উদ্যোগেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। মিঃ রেমন্ড হেলাইচ পাইন নামে এক ইংরেজ স্থপতি মন্দিরটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৭১ সালে রাজা যোগেন্দ্রদেব রায়কতের আমলে মন্দিরটির সংস্কার করা হয়।
ডাকাত সর্দার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন ভবানী পাঠক, যদিও তিনি সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করতেন। শোনা যায় তিনি অত্যাচারী ইংরেজ ও দেশীয় জমিদারদের ওপর লুঠতরাজ চালিয়ে তা দীন-দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন সম্পত্তি। তাঁর সুযোগ্য শিষ্যা ছিলেন দেবী চৌধুরানী।
এই দুই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়েই সাহিত্যসম্রাট লিখেছিলেন উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশের রংপুরের মন্থনী রাজ এস্টেটের সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী নামে এক তেজস্বিনী মহিলা। তাঁকেই কল্পনায় দেবী চৌধুরানী হিসাবে রূপ দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে ইতিহাস যা-ই বলুক না কেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কিন্তু ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী দেবতাই।
প্রথমে কাঠের মূর্তি তৈরী করা হলেও তা পুড়ে যাওয়ায় পরে মাটির প্রতিমা তৈরী করা হয়েছে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর। অন্য মুর্তিগুলি এখনও কাঠের। কাঠের তৈরী মণ্ডপ। শিকারপুর চা বাগান কর্তৃপক্ষই এর দেখাশোনা করেন।