ড্রাগ আসক্তি এবং তার চিকিৎসা
ভারতে মাদকাসক্তি সংক্রান্ত সমস্যাটি ক্রমশই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। পাঞ্জাবের মতো কিছু রাজ্যে প্রকোপ ভয়াবহ, প্রায় ৭৫ শতাংশ তরুণ এই ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তি অতি দ্রুততার সাথে, সমাজের জন্য বিপজ্জনক থাবা ছড়িয়ে দিচ্ছে। দিল্লি, মুম্বাই এবং হায়দ্রাবাদের মতো বড় বড় শহরের পরিস্থিতিও ক্রমশঃ খারাপের দিকে।
ড্রাগের আসক্তি কিভাবে তৈরী হয়
প্রথমে কৌতূহলে, অন্যকে দেখে, শিক্ষা বা ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার জন্য অথবা মানসিক অস্বস্তি বা সমস্যা কাটাতেই ড্রাগ নিতে শুরু করে। ক্রমশ এর প্রভাবে মস্তিষ্কের ক্রিয়ায় পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে আসক্ত ব্যক্তি ড্রাগের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং গ্রহণের মাত্রা ছাড়ায়।
তাঁরা ড্রাগ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুটই হারিয়ে ফেলেন। চাইলেও এর হাত থেকে নিস্তার পান না।নেশা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে হলে আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও সহায়তা পাওয়া জরুরি।
মস্তিষ্কে ড্রাগ কীভাবে প্রভাব ফেলে
মানব মস্তিষ্কে ড্রাগের লক্ষণীয় ক্রিয়া হল ডোপামিন নিস্কাশন। ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার। ড্রাগ ব্রেনের বার্তাবহ ব্যবস্থার উপর বেশি রকম ক্রিয়াশীল হয়। এর ফলে ডোপামিন ক্ষরণ হতে থাকে এবং মস্তিষ্কে এক ধরনের আরাম অনুভূত হয়। মস্তিষ্ক সেই অনভূতি বারবার চাইতে শুরু করে। এভাবেই ড্রাগের প্রতি টান তৈরী হয়।
নিয়মিত সেবনের ফলে মস্তিষ্কে সচেতন অবস্থার ঘাটতি দেখা দেয়। ড্রাগের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে মস্তিষ্কে আগেকার স্বাভাবিক অবস্থার অনুভূতি পাওয়ার জন্য। পরোক্ষে মস্তিষ্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় আরও ড্রাগের চাহিদায়, যা মানুষের কোনও প্রকৃত ধারণাতে আসে না।
দীর্ঘদিন ধরে ড্রাগের নেশা ব্রেনের কগনিটিভ ফাংশন বা পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। নিয়মিত ড্রাগ ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্রেনের যে অংশগুলি শিক্ষা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে সেইগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তি ডিপ্রেশন ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
অন্যান্য সমস্যাগুলি হল – কাঁপুনি থামতে না চাওয়া, খিদে ও ঘুম কমে যাওয়া, ওজন কমা-বাড়া, অসামাজিক হয়ে পড়া, অল্পে রেগে যাওয়া, নার্ভাস বা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা, উদ্বেগ ও সন্দেহবাতিক বেড়ে যাওয়া।
ড্রাগ অ্যাডিকশন আছে কিনা বুঝবেন কি করে
- কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে কোনও মানুষের ড্রাগ নেওয়ার অভ্যাস আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে কি না তা বোঝা যায়।
- ড্রাগ নেওয়ার পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে কি না।
- উইথড্রয়াল সিম্পটম, বা ড্রাগের প্রভাব শেষ হয়ে গেলে যে শারীরিক লক্ষণগুলো দেখা যায়, যেমন কাঁপুনি, খিঁচুনি ইত্যাদি প্রথম ডোজ নেওয়ার আগে বেড়ে যাওয়া।
- নিজের জন্য একটা ড্রাগ-মুক্ত দিনও কল্পনা করতে না পারা।
- পরবর্তী ডোজটি নেওয়ার জন্য নানারকম বাহানা তৈরী করা।
- দিনের শুরুতেই কিছুটা ড্রাগ নেওয়া।
- পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে অনীহা।
- সব সময় অন্যদের থেকে ড্রাগের অভ্যাস আড়াল করার চেষ্টা।
- ড্রাগের অভ্যাসের জন্য নিজেকে অপরাধী ও লজ্জিত মনে হওয়া।
- মনে হয় ছেড়ে দেব, কিন্তু কোনওভাবেই না পারা।
এই বিষয়গুলি যদি ড্রাগ ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়, তাহলেই তার বিশেষ সহায়তার প্রয়োজন। সিএজিই (CAGE) বা “কেজ” টেস্টের আধুনিক ভার্সান মানুষ ড্রাগ অ্যাডিকটেড কি না জানতে সাহায্য করে।
চিকিৎসাঃ –
ড্রাগের নেশার চিকিৎসা চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভরশীলঃ –
১) রোগীর শরীর থেকে ড্রাগের কারণে জমা হওয়া টক্সিন বের করা।
২) রোগীকে নেশার টান এবং উইথড্রয়াল সিম্পটম সামলাতে সাহায্য করা।
৩) আসক্তিজনিত যে কোনও মানসিক ও আবেগজড়িত বিষয়ে রোগীকে সামলানোর জন্য সহায়তা করা।
৪) নেশার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করা।
অধিকাংশ রোগীর অল্প সময়ের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এরপর রিহ্যাবিলিটেশন এবং ফলো আপ সেশনের মাধ্যমে নেশামুক্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয়। চিকিৎসা পদ্ধতির এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হল আবার নেশার কবলে পড়া থেকে বিরত রাখা।
একজন ড্রাগ অ্যাডিক্টের চিকিৎসা করে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর যখন সে নেশা ছাড়া কিছুদিন থাকে, তখনই আবার নেশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। যাকে রিল্যাপ্স বলে। এর সঠিক মোকাবিলা করতে হলে প্রাথমিক চিকিৎসার সঙ্গেই সমানতালে নজরদারি প্রয়োজন। যাতে রোগী নিজেই নেশার টান এড়িয়ে যেতে পারে।