বিধ্বস্ত সুন্দরবনের পাশে ‘সুন্দরবনের জন্য’
২০০৯-এ ঘর ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরের দুনিয়ায় পা ফেলতে বাধ্য করেছিল ঘূর্ণিঝড় আয়লা। ১১ বছর পর ফের ঘরমুখী হতে বাধ্য হলেন ওঁরা। সে বার রুষ্ট প্রকৃতি, এ বার সংক্রামক ভাইরাস। কিন্তু ১১ বছরের ব্যবধানেও অবস্থা ফিরল না। ঘোর বিপদে সুন্দরবন ও সুন্দরবনবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানে উদ্যোগ নিলেন কলকাতার কয়েকজন। সুন্দরবনের জন্য তাঁদের সংগঠন ‘সুন্দরবনের জন্য’।
পেটের খিদে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল সুন্দরবনের কুমিরমারী ও ছোট মোল্লাখালির বাসিন্দা নিবাস মণ্ডল, দেবাশিস ঘোষাল, উত্তম রাফতান প্রমুখদের। করোনাভাইরাসের দেশজোড়া দৌরাত্মে তাঁদের ঘরে ফিরে পেট চালিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন উড়িয়ে নিয়ে গেল সুপার সাইক্লোন উম্পুন। না ঘর কা, না ঘাট কা — এঁদের অবস্থা এখন এমনই।
১১ বছর আগে আয়লার দাপটে সুন্দরবনের বহু জায়গার পুকুর ভরে গিয়েছিল নোনা জলে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাছের চাষ। জীবিকা হারিয়ে কাজের আশায় অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরালা ইত্যাদি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। করোনাভাইরাসের দাপটে ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন যখন, তত দিনে তাঁদের ‘নিজের জায়গায়’ কায়িক পরিশ্রমের স্বাভাবিক দক্ষতা নষ্ট হয়েছে বহু দিনের অনভ্যাসে। ঘরে ফিরে যে আগের মতো কাজ শুরু করবেন, সেই পথও বন্ধ হল উম্পুনের জন্য। পুকুরগুলো ফের ভরেছে নোনাজলে। এ বার ওঁরা বাধ্য হলেন জঙ্গলের ভুলে যাওয়া পথ ধরতে। মধু সংগ্রহ করা, মাছ ধরা বা কাঁকড়া ধরা ছাড়া পেট চালানোর আর উপায়ই বা কী! বাঘ ও কুমিরদের মহোৎসব শুরু হল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন গত এক মাসে জঙ্গল থেকে ফেরেননি অন্তত সাত-আট জন।
চাল-ডালের বস্তা বা অন্য শুকনো খাবার ও জামাকাপড়ের ত্রাণ যে এখানকার মানুষদের স্থায়ী সমাধান নয়, সেটা প্রথমবার ত্রাণ নিয়ে গিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন কলকাতার প্রাঞ্জল দাস, তিমির বিশ্বাস, অর্পিতা চৌধুরী, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়ম সেনগুপ্ত ও পার্থ বিশ্বাস। ওঁরা বুঝেছেন, করোনা-উম্পুনে বিধ্বস্ত এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি ‘প্রকল্প’ দরকার। ওঁরা দেখলেন, স্থানীয় পুকুর নোনা জলের পরিবর্তে মিঠে জলে ভরে উঠলেই ফের মাছচাষ শুরু করতে পারবেন স্থানীয়রা। ‘সুন্দরবনের জন্য’ নামে একটি সংগঠন গড়ে স্থানীয় পুকুরগুলোকে সংস্কার করার কাজ শুরু করলেন সবাই মিলে।
সুন্দরবনের জন্য-র পক্ষ থেকে প্রাঞ্জল বলছেন, ‘আমরা প্রাথমিক ভাবে ৩০টা পুকুরকে চিহ্নিত করেছি। প্রাকৃতিক ভাবে ওই পুকুর আগের অবস্থায় আসতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগত। কিন্তু আমরা এক বছরের কম সময়ে পুকুর সংস্কার করতে পারব। ইতিমধ্যেই ফল আশাপ্রদ। ইতিমধ্যেই ভেটকি ও চিংড়ির চাষ শুরু হয়েছে।’
শুধু ৩০টা পুকুরেই সংস্কারের কাজ সীমাবদ্ধ থাকবে না, আগামী দিনে একটা খাল সংস্কারের কাজেও হাত দেবে ‘সুন্দরবনের জন্য’। সংগঠন জানাচ্ছে, পুকুর সংস্কারের জন্য মোট ৬০ হাজার টাকা লাগবে। এই টাকার সিংহভাগ জোগাড় হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়ে।