বিধান রায়, ক্রুশ্চেভ ও গঙ্গাবক্ষে ঈশ্বর আলোচনা
সালটা ১৯৫৬ সালে ৩রা জুলাই ভারতে এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান দুই নেতা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই বুলগানিন এবং সেই সময়ের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতা, সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ।
এই উপলক্ষ্যে কলকাতার ব্রিগেডে জনসভা হয়েছিল। কত মানুষ এসেছিলেন? কারও মতে ৫ লক্ষ। কেউ বলেন দশ। সভা উপলক্ষে ব্রিগেডের মঞ্চে সেদিন ওই দুই সোভিয়েত নেতা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়। জনসমাবেশ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন দুই সোভিয়েত নেতা।
এই সভার পরের দিন ক্রুশ্চেভ এবং বুলগানিনকে নিয়ে গঙ্গায় লঞ্চে করে বিধান রায় গেলেন শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাতে। রাতে হল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নৈশভোজ।
লঞ্চে যাত্রাপথে দুই সোভিয়েত নেতার সঙ্গে বিধান রায়ের যে কথা হয়েছিল, সে কথা পরে তাঁর কাছে শুনে অশোককৃষ্ণ দত্ত লিখেছিলেন ‘এক মহান ব্যক্তিত্ব’ রচনাটি। যা পরে নথিবদ্ধ করেন অশোককুমার কুণ্ডু তাঁর ‘ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়’ জীবনীতে।
মাঝ গঙ্গায় বিধান রায় সোভিয়েত নেতাদের লঞ্চ থেকে শহর দেখাতে দেখাতে লন্ডন, নিউইয়র্ক, হামবুর্গ ইত্যাদি শহরে টেমস বা হাডসন বা এলবে নদীবক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতির সঙ্গে কলকাতার তুলনা করছিলেন। এসব শুনতে শুনতে ক্রুশ্চেভ হঠাৎ বললেন, ‘আপনি তো শুধু ক্যাপিটালিস্ট দেশের তুলনা করছেন, কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের কথা তো বলছেন না’!
বিধান রায় হেসে বললেন, ‘আমি তো ওই সব দেশেই গিয়েছি। আমি তো কখনও কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশ দেখিইনি’। ক্রুশ্চেভ তা শুনে বললেন, ‘কেন যাননি কেন’? বিধান রায় জবাবে বললেন, ‘ওরা আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তাই গিয়েছি। আমাদের অত বিদেশী মুদ্রা নেই যে বিদেশে বেড়াতে যাব’।
তা শুনে ক্রুশ্চেভ হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নে আসুন, যত দিন খুশি থাকুন, দেখুন আমরা কেমন কাজ করছি’। বিধান রায় হেসে বললেন, ‘বড্ড দেরী করে ফেলেছেন আপনারা। এত বয়েসে আর কি যাওয়া হয়। কবে মরে যাব’। ক্রুশ্চেভ গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘মরে গেলে লাল ফৌজ কুচকাওয়াজ করে আপনাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে’। এই বার বিধান রায় বললেন, ‘না ভাই আমি কোনও গডলেস কান্ট্রিতে মরতে চাই না’।
ক্রুশ্চেভ অবাক হয়ে বলেন, ‘সেকি। ডাক্তার, তুমি তো বিজ্ঞান মানো, ঈশ্বরও মানো? দেখেছ কখনও ঈশ্বরকে’? বিধান রায় বললেন, ‘আপনি কি কখনও বিদ্যুৎ দেখেছেন’? ক্রুশ্চেভ বললেন, ‘না তা দেখিনি, কিন্তু সেই শক্তির প্রভাবে এই লঞ্চ চলছে, ওই আলো জ্বলছে’, এসব হল ওই বিদ্যুৎ শক্তির ফলিত প্রকাশ। বিধান রায় বললেন,‘ আমিও সেই ফলিত প্রকাশ দেখেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’।
এর পরও দু’জনে অনেক আলোচনা হল ঈশ্বর নিয়ে। ক্রুশ্চেভ বিধান রায়ের সঙ্গে কথা বলে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে দেশে ফিরে তিনি বিধান রায়ের জন্য একটি বিশেষ বিমান উপহার দিতে চাইলেন। বিধান রায় তাঁকে লিখলেন, ‘আমার কী আর এরোপ্লেন নিয়ে খেলার বয়স আছে! আপনি বরং আমাদের মেডিক্যাল কলেজের জন্য কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি পাঠান’।
কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসে পৌঁছেছিল সেই সব আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি।যা স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল শিক্ষায় কাজে লেগেছিল।