দাদুর দেহে বসে নাতি, কাশ্মীরের ছবিতে ঝড় দেশে
সাদা জামা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। রাস্তার ধুলোয় পড়ে প্রৌঢ়ের নিথর দেহ। আর সেই দেহের উপরই বসে বছর তিনেকের এক শিশু। গালে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে অসহায়তা। দাদুর সঙ্গে শ্রীনগর থেকে গাড়ি করে হান্দওয়াড়া রওনা দিয়েছিল ছোট্ট ছেলেটা। মাঝপথে সোপোরে জঙ্গি ও সিআরপিএফের গুলিযুদ্ধের মধ্যে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন দাদু। রাস্তার মাঝে অসহায় একা শিশু!
বুধবার সকাল থেকেই এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অশান্ত কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের অসহায়তার জীবন্ত দলিল! সিআরপিএফের বয়ান অনুযায়ী, বুধবার সকালে সাড়ে সাতটা নাগাদ সিআরপিএফের একটি টহলদার বাহিনী বাসে করে সোপোরে পৌঁছয়। জওয়ানরা বাস থেকে নামা মাত্র কাছের একটি মসজিদ থেকে তাঁদের লক্ষ করে গুলি চালাতে শুরু করে জঙ্গিরা। গুরুতর আহত হন চার সিআরপিএফ আধিকারিক, যাঁদের মধ্যে হেড কনস্টেবল দীপ চাঁদ পরে মারা যান। জঙ্গি-সিআরপিএফের গুলিযুদ্ধের মধ্যে পড়ে যান বশির আহমেদ খান। গুলিতে তাঁদের গাড়িটি ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। নাতিকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে কাছের কোনও নিরাপদ স্থানে গা ঢাকা দিতে চেয়েছিলেন বছর পঁয়ষট্টির বশির। তখনই জঙ্গিদের দিক থেকে ছুটে আসা দু’টো গুলি বশিরের গায়ে লাগে, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। পুলিশ তাঁর নাতিকে গুলি থেকে বাঁচিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
পুলিশ এবং সিআরপিএফের এই বক্তব্য অবশ্য মানতে নারাজ বশিরের পরিবার। বশিরের ছেলে সুহেল আহমেদের দাবি, কোনও গুলিযুদ্ধ নয়, তাঁর বাবাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে সিআরপিএফ। তাঁর প্রশ্ন, বশির যদি গুলিযুদ্ধেই মারা গিয়ে থাকেন, তা হলে ওই গোলাগুলির মধ্যে বাচ্চাটাকে সরানোর চেষ্টা না করে তার ছবি তুলে ভাইরাল করল কে? ঘটনাস্থলে কোনও চিত্রসাংবাদিক বা পথচারী ছিলেন না, তা মেনে নিয়েছেন সিআরপিএফের মুখপাত্র জুনেইদ খানও। বাচ্চাটিকে উদ্ধারের পর পুলিশকর্মীর কোলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং কান্না থামানোর ছবি টুইট করেছে কাশ্মীর পুলিশই। কিন্তু মৃতদেহের উপর অসুরক্ষিত, অসহায় বাচ্চাটির ছবি কে ভাইরাল করল? মিলছে না জবাব।
এর মধ্যে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। পুলিশ ও বাহিনীকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর টুইট, ‘রক্তাক্ত কাশ্মীরে সবকিছুই প্রোপাগান্ডা হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বের সামনে ভালো-খারাপের বিভাজন বোঝাতে একটা তিন বছরের শিশুর অসহায়তাকে এ ভাবে ছবি তুলে ভাইরাল করা হল কেন? উর্দিধারী মানুষগুলো বাচ্চাটিকে উদ্ধার করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার আগে ওই ছবি তুলে তাঁরা যে ভাবে বাচ্চাটার কষ্ট নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন, এটা প্রত্যাশিত ছিল না।’
ছবি-বিতর্কে সিআরপিএফের পাল্টা প্রশ্ন, এই গুলিযুদ্ধে শুধু বশির নন, প্রাণ গিয়েছে তাঁদের এক সহকর্মীরও। তবে কি ছবি ভাইরাল করার জন্য নিজেদের লোকেরই প্রাণ নিয়েছে তারা? কাশ্মীরের আইজিপি বিজয় কুমারের দাবি, জঙ্গিদের হুমকির মুখেই সিআরপিএফকে কাঠগড়ায় তুলছে বশিরের পরিবার। শিশুর ছবিটি যে তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছে, তার শাস্তির আশ্বাসও দিয়েছেন আইজিপি।
দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেই বশিরের মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে সরব হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টি। তাদের দাবি, ক’দিন আগে অনন্তনাগে এ ভাবেই সিআরপিএফের উপর জঙ্গিহানার সময় বুলেট লেগে প্রাণ যায় ছ’বছরের এক শিশুর। একের পর এক নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর পরও কেন সতর্ক হচ্ছে না বাহিনী? গাফিলতি কার?