অঙ্কের বইয়ের বাইরে কতটা চেনেন নাগ বাবুকে?
বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে অঙ্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অপরিহার্য সঙ্গী কে সি নাগের অঙ্ক বই। অঙ্কভীতি রয়েছে যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর, তাদের কাছে সে বই সাক্ষাৎ যম। আর অঙ্ক-পাগল ছেলেদের মন মজে যায় কেশবচন্দ্র নাগের পাটীগণিত, বীজগণিতের সমস্যার জট ছাড়াতে।
কে ছিলেন এই কে সি নাগ?
কেশবচন্দ্র নাগের জন্ম ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই – রথযাত্রার দিন – হুগলীর গুড়াপের নাগপাড়ায়। শৈশবেই পিতা রঘুনাথের মৃ্ত্যু হয়। মা ক্ষীরোদাসুন্দরী মানুষ করেন সন্তানদের। স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পরে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে। ১৯১৪-এ আইএসসি পাশ করেন। প্রবেশিকা এবং আইএসসি— দুই পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
কলেজ জীবনেই রোজগারের জন্য টিউশনি শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ভাস্তাড়া স্কুলেই। প্রবাদপ্রতিম শিক্ষাবীদ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানেও পৌঁছে যায় কেশবচন্দের নাম। স্যার আশুতোষের উদ্যোগেই কেশবচন্দ্র কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে অঙ্ক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কালে কালে সেই স্কুলের হেড মাস্টার হয়েছিলেন তিনি। হেড মাস্টার পদে থাকাকালীনই তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
প্রাথমিক ভাবে তাঁর বাস ছিল রসা রোডের একটি মেসে। পরে ১৯৬৪ সালে দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনে নিজের বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন।
কেশবচন্দ্র নিছক গণিতজ্ঞ ছিলেন না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক জন সাহিত্যমোদী মানুষ। মিত্র ইনস্টিটিউশনে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবিশেখর কালিদাস রায়। কবিশেখরের বাড়িতেই ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’ নামে এক সাহিত্যসংগঠনের আড্ডা বসত নিয়মিত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কিংবা জলধর সেনের মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিকের যাতায়াত ছিল সেই আড্ডায়। সাহিত্যপ্রিয় কেশবচন্দ্রও ছিলেন সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য।
কালিদাস গণিতে কেশবচন্দ্রের গভীর বুৎপত্তি দেখে বন্ধু তথা সহকর্মীকে উৎসাহ দিতে থাকেন একটি অঙ্ক বই লেখার ব্যাপারে। ইউ এন ধর অ্যান্ড সনস প্রকাশনা সংস্থার তরফে ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রকাশ পায় কেশবচন্দ্রের লেখা প্রথম অঙ্ক বই ‘নব পাটীগণিত’। পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই বই অল্পকালের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা পায় বইটি।
১৯৪২ সালে ক্যালকাটা বুক হাউজের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল কেশবচন্দ্রের অঙ্কের খাতাটিই বইয়ের আকারে প্রকাশের ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। অঙ্ক-সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথেমেটিক্স’ নামে প্রকাশ পায় সেই খাতা। প্রকাশের অল্পকালের মধ্যেই সেই বইও ব্যাপক সাফল্য পায়। তার পর একে একে বিভিন্ন শ্রেণীর বহু বই লেখেন কেশবচন্দ্র। হিন্দী, উর্দু, ইংরেজী সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় তাঁর বই। ১৯৫৫ সালে নাগ পাবলিশিং হাউজ প্রতিষ্ঠা করে নিজের বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
কেশবচন্দ্র ছিলেন ছিলেন সারদা মায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্য। সাহিত্যিক-প্রতিভাও ছিল তাঁর। ‘রত্ন-বেদী’ নামে নিজের দিনলিপিতে টুকরো কবিতা ও ভক্তিমূলক গান লিখেছেন অজস্র। অনুবাদক হিসেবে স্বামী অভেদানন্দের ইংরেজী বক্তৃতা এবং ভগিনী নিবেদিতার বেশ কিছু লেখা অনুবাদ করেছিলেন তিনি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেছেন।
খেলাধূলাতেও প্রবল উৎসাহ ছিল কেশবচন্দ্রের। মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য ছিলেন সারা জীবন। ১৯৮৫ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কানপুরে অনুষ্ঠিত ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের ধারাবিবরণী শুনছিলেন রেডিওতে। সেই সময়েই খেলার উত্তেজনায় সেরিব্রাল স্ট্রোক হয় কেশবচন্দ্রের। ১৯৮৭-র ৬ই ফেব্রুয়ারি কেশবচন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।