পাকা বাঁধ ও ম্যানগ্রোভের দাবি জোরালো হচ্ছে সুন্দরবনে
আয়লাতে যা হয়নি, আম্পান বাদাবনের গাছগাছালিতে সেই ধ্বংসচিহ্ন রেখে গিয়েছে। অরণ্যের বহু গাছের পাতা শুকিয়ে হলুদ হয়ে গিয়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে আম-জাম-কাঁঠাল, এমনকি নারকেল গাছও। তা হলে যুগ যুগ ধরে যে ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের ঢাল হিসেবে পরিচিত ছিল, তা-ও কি শেষের পথে?
না, তেমন আশঙ্কার কারণ নেই। আশ্বস্ত করছেন ম্যানগ্রোভ এবং বাস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পুনর্বসু চৌধুরী। তিনি বলেন, “সুন্দরবনে দু’ধরনের গাছ রয়েছে। ‘হলোফাইট’ এবং ‘নন-হলোফাইট’। হলোফাইট হল সেই সব গাছ, যা অতিরিক্ত লবণ সহ্য করতে পারে। আয়লা এবং আম্পানে সেই সব গাছের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে অন্য গাছের। ফলে, ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। আরও বেশি ম্যানগ্রোভ লাগানো দরকার। তা হলেই বাঁচবে বাদাবন।” বাদাবন না হয় বাঁচবে। কিন্তু ঝড়ে ঘর-বাড়ি, রুজি-রোজগার হারানো মানুষগুলোর কী উপায় হবে?
লকডাউন এবং আম্পানে সুন্দরবনের অর্থনীতি যে তলিয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে নিঃসংশয় অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। ঘুরে দাঁড়ানোর উপায়কে অভিরূপ দু’ভাগে ভাগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। অভিরূপ বলছেন, “প্রথম ধাপ সারভাইভাল অর্থাৎ, অস্তিত্ব রক্ষা। এটা মানুষের আশু প্রয়োজন। সে জন্য কয়েক মাস ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে সরাসরি নগদ টাকা পৌঁছে দিতে হবে। সঙ্গে বাড়ি তৈরির জন্য অর্থ সাহায্য।’’ কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নগদ টাকা জোগানো যে স্থায়ী সমাধান নয়, সে কথাও মানছেন ওই অর্থনীতিবিদ।
অভিরূপের প্রস্তাব, দ্বিতীয় ধাপ হোক ‘রিভাইভাল’। অর্থাৎ, পুনর্গঠন। তিনি মনে করেন, পুনর্গঠনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পুরো সুন্দরবনে কংক্রিটের স্থায়ী বাঁধ। একই মত পুনর্বসুরও। দু’জনেই বলছেন, “ঝড় আটকানোর কোনও পথ নেই। কিন্তু ঝড়ের ফলে বাঁধ ভেঙে বা ছাপিয়ে বিঘের পর বিঘে জমি-পুকুর-পানীয় জলের নলকূপ যে নোনা জলে ডুবে যাচ্ছে, বাঁধ দিয়ে সেটা রোখা জরুরি। সে জন্য মোটা টাকা বরাদ্দ করতে হবে। ঝড়ে ঘর-বাড়ি ভাঙলে তা সামাল দেওয়া যাবে।”
দুই জেলা মিলিয়ে সুন্দরবনের বাঁধের দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। তার মধ্যে মাত্র ২০০ কিলোমিটার কংক্রিটের রয়েছে। অভিরূপের আরও প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। সেই প্রকল্পে ছোট হলেও ধাপে ধাপে পাকাবাড়ি তৈরির টাকা দেওয়া হোক।
অর্থনীতিবিদেরা তো বটেই, দুই জেলার প্রশাসনিক কর্তারা চাইছেন, বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যেমন মৌলিদের মৌমাছি প্রতিপালনের প্রশিক্ষণ এবং অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। তাঁদের উৎপাদিত মধু আবার সরকারই কিনে নিচ্ছে মোটা দামে। তা বিক্রি হচ্ছে কলকাতার শপিং মল, ই-কমার্স সাইটে। প্রশাসনিক কর্তারা বলছেন, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে এ রকম ছোটখাটো প্রকল্প তৈরি জরুরি। কৃষি এবং মৎস্য নির্ভর প্রকল্প জরুরি। প্রাণী ও পশুপালন বা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে হস্তশিল্প নির্ভর কাজের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে।
পুনর্বসুর মত, সুন্দরবনের প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না এমন প্রকল্প প্রয়োজন। বাঁধের উপর সেই সব ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো জরুরি যাঁদের ঠেসমূল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গরান এবং গর্জন গাছ লাগানোর পক্ষপাতী তিনি। ম্যানগ্রোভের সুফল এ বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুমিরমারিতে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁদের অফিসের চারদিকে গরান, গর্জন গাছের প্রাচীর তৈরি করেছে। আপমানে তাঁদের অফিস বিল্ডিংয়ে আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি।
গাছ বাঁচলে প্রাণ বাঁচবে, নতুন কথা নয়। কিন্তু পাকা বাঁধ না-হলে সুন্দরবন এবং জনজীবন যে ঘূর্ণিঝড়ে বারবার এ ভাবেই তছনছ হবে, বিশেষজ্ঞেরাই শুধুই নয়, সুন্দরবনের আমবাসিন্দাও জানেন সে কথা।