কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সম্পর্ক?
রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একে অপরের পরম বন্ধু। একে অপরের সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে তাঁদের এই সখ্যতা গড়ে ওঠে। দু’জনেই বিলেতে প্রবাস-জীবন কাটিয়েছেন, ইংরেজি ও আইরিশ গানে মেতেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর শ্রদ্ধা।
দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘বিরহ’ নাটক উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ‘পূর্ণিমা মিলন’, ‘খামখেয়ালি সভা’য় দ্বিজেন্দ্রলাল হাসির গানের বন্যা বইয়ে দিতেন। তাতে গলা মেলাতেন রবীন্দ্রনাথ আর অতুলপ্রসাদ সেন। একসময় রবীন্দ্র ভক্তরা এবং দ্বিজেন ভক্তরা দুটি আলাদা গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়। সেই সময় রবীন্দ্র নাথ দ্বিজেন্দ্র লাল রায় সম্পর্কে বলেনঃ
‘‘দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বাংলার পাঠকসাধারণের নিকট পরিচিত ছিলেন না তখন হইতেই তাঁহার কবিত্বে আমি গভীর আনন্দ পাইয়াছি এবং তাঁহার প্রতিভার মহিমা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হই নাই। দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সত্য, অর্থাৎ আমি যে তাঁর গুণপক্ষপাতী, এইটেই আসল কথা এবং এইটেই মনে রাখিবার যোগ্য।
আমার দুর্ভাগ্যক্রমে এখনকার অনেক পাঠক দ্বিজেন্দ্রলালকে আমার প্রতিপক্ষশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া কলহের অবতারণা করিয়াছেন। অথচ আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি এ কলহ আমার নহে এবং আমার হইতেই পারে না। পশ্চিম দেশের আঁধি হঠাৎ একটা উড়ো হাওয়ার কাঁধে চড়িয়া শয়ন বসন আসনের উপর এক পুরু ধুলা রাখিয়া চলিয়া যায়।
আমাদের জীবনে অনেক সময়ে সেই ভুল-বোঝার আঁধি কোথা হইতে আসিয়া পড়ে তাহা বলিতেই পারি না। কিন্তু উপস্থিতমত সেটা যত উৎপাতই হোক্ সেটা নিত্য নহে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে আমার নিবেদন এই যে, তাঁহারা এই ধুলা জমাইয়া রাখিবার চেষ্টা যেন না করেন, করিলেও কৃতকার্য হইতে পারিবেন না।
কল্যাণীয় শ্রীমান দেবকুমার তাঁহার বন্ধুর জীবনীর ভূমিকায় আমাকে কয়েক ছত্র লিখিয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছেন। এই উপলক্ষে আমি কেবলমাত্র এই কথাটি জানাইতে চাই যে, সাময়িক পত্রে যে-সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয় তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব-সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনো তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই।
আর যাহা-কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র, তাহার সম্পূর্ণ কারণ নির্ণয় করিতে আমি তো পারিই না, আর কেহ পারেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না।’’