ছকভাঙা প্রেমের মহাকাব্য – নগরকীর্তন
প্রেমের কোনও লিঙ্গ নেই। বর্ষার দুটি ফোটা যেমন পদ্মপাতায় নির্দ্বিধায় এক হয়ে যায়, যেমন করে বিদ্যুতের তারের ওপর জমে থাকা জলের বিন্দু প্রবাহিত হয় একে অপরের দিকে, তেমনই শরীরের স্নায়বিক প্রবাহ মানবদেহকে কোন পথে চালিত করবে, কেউ জানে না। সকলেই খুঁজে বেড়ায় তার নিজের জলবিন্দুকে। একাকার হওয়ার লক্ষ্যে। কেউ কেউ এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, কেউ বা সময়ের সারণিতে পাদটীকা হিসেবেই রয়ে যায়।
পুঁটি এবং মধুদের ভালোবাসা এই দ্বিতীয় পর্যায়ের। তাদের প্রেমজুড়ে শুধুই বিষাদ, বিরহ ও আর্ত যন্ত্রনা। কৌশিক গাঙ্গুলির জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবি ‘নগরকীর্তন’ এমনই ভিন্ন স্বাদের প্রেমের গল্প বলে। সমাজের প্রান্তিক মানুষের আশাহীন জীবন যুদ্ধ, আকুলতার প্রেম, আর অসহায়তার মহাকাব্য রচিত হয় ছবিজুড়ে।
এক দশক আগে কৌশিক গাঙ্গুলি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’। সমাজের স্রোতের বিপরীতে স্রোতস্বিনী প্রেমের এই ছকভাঙা প্রবাহের বেদনা অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ফ্রেমে। নগরকীর্তনে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন পরিচালক। ক্ষুরধার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন বাস্তবচিত্র।
পুটি বা পরিমালের চরিত্রে ঋদ্ধি সেন এতটাই স্বাভাবিক যে মনে হবে আপনি অভিনয়ের কোনও মাস্টারক্লাস দেখছেন। মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা এক মেয়েলি ‘ছেলে’ একবার প্রেমে প্রতারিত হয়েও লড়ে যায় বেঁচে থাকার জন্য, নিজের অন্তরস্বত্ত্বার জন্য। পরিবার লোকলাজের ভয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু সে বাঁচতে চায়, ভালোবাসতে চায়। সমাজ কি মেনে নেবে?
ঋদ্ধিকে যথাযথ সঙ্গত দিয়েছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, মধুর চরিত্রে। পুরুষের দেহে আটকা একটি মহিলার প্রেমে পড়াটা যে অস্বাভাবিক কিছু নয়, অকাতরেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। মধুর ভেতরের টানাপোড়েনকে চিত্রায়িত করেছেন সাবলীলভাবে। এই জুটির যন্ত্রনা অনুধাবন করতে পারেন একমাত্র মধুর বৌদি। অভিনয়ে বিদীপ্তা চক্রবর্তী। তাঁর চরিত্রের সংবেদনশীলতা ছবিকে এক অন্য মাত্রা দেয়। সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়া প্রান্তিক মানুষকে আশা যোগায়
কৌশিক গাঙ্গুলির ভাবনাকে পর্দায় যথাযথ ফুটিয়ে তোলার পেছনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তারা হলেন চিত্রগ্রাহক শীর্ষ রায়, সম্পাদক শুভজিৎ সিংহ এবং সঙ্গীত পরিচালক প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। অসামান্য নৈপুণ্যে পুটি আর মধুর প্রেমগাঁথাকে ভালোবাসার মহাকাব্যে রূপান্তরিত করেছেন তারা। পরিসমাপ্তির পরেও গলায় দলা পাকানো কান্না আর ভেজা চোখের পাতা বাধ্য করবে আপনাকে ভাবতে, প্রশ্ন করতে।
বক্স অফিস বা সামাজিক মাধ্যমের ভিউ নয়, এই ছবি দেখার পর যদি গৎবাঁধা ছকের বাইরের মানুষগুলিকে একটু হলেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানবিকতার সাথে দেখেন, তবেই সফল হবে নগরকীর্তন।