ভারতের পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস জানেন কি?
ভারতের জাতীয় পতাকা বলতে আমরা তিরঙ্গা পতাকাই জানি। গেরুয়া, সাদা, সবুজ পতাকার মাঝে নীল অশোক চক্র – এটাই স্বাধীন ভারতের ধ্বজা। কিন্তু জানেন কি, স্বাধীনতার আগে বহুবার বিবর্তন হয়েছে ভারতের পতাকার? আসুন দেখে নিই সেই ইতিহাস।
১. ১৮৮৩ সালের পতাকা
ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। তখন থেকই ‘জাতীয়’ কথাটার উদ্ভব হয়। দেশপ্রেম জাগতে শুরু করে। সেই পতাকা ছিল সাদা বর্গাকার পতাকার মাঝে লাল রক্তিম সূর্য। পাকিস্তানের লাহোর নিবাসী শিরিষ চন্দ্র বসু এই পতাকার প্রস্তাব দেন।
২. ১৯০৫ সালের পতাকা
“অনুশীলন সমিভির’ সভাপতি ব্যারিষ্টার প্রমথ নাথ মিত্র ১৯০৫ সালের ৭ অগাস্ট জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেছিলেন। পতাকার রং ছিল ত্রিবর্ণ। উপরে লাল, মাঝে হলুদ নীচে সবুজ। লালের উপর আঁকা অষ্টবৃন্তের আটটি কুসুম। হলুদের উপর সংস্কৃতে লেখা বন্দেমাতরম। সবুজের উপর সূর্য ও অর্ধচন্দ্র।
এরপর ওই একই আদলে চার রকমের পতাকা বিবর্তন হয়। মেদিনীপুরের স্বদেশী আন্দোলনকারীরা একটি পতাকার প্রস্তাবনা করেছিলেন। তা ছিল লাল হলুদ ও নীল। মাঝে বাংলায় লেখা বন্দেমাতরম। ব্রিটিশ শাসনে আটটি প্রদেশকে চিহ্নিত করতে কখনও প্রস্ফুটিত পদ্ম কখনও অষ্ট কুসুমকে পতাকার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
৩. ১৯০৬ সালের পতাকা
বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর সমিতি পার্টি কংগ্রেসে একটি পতাকার প্রস্তাব করেছিল। পতাকাটি ছিল লাল রঙের এবং তলোয়ার ও ত্রিশুল গুনিতক আকারে অবস্থান করছে। উপরে চাঁদ ও নীচে চক্র। ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্র নাথ দত্তের প্রস্তাবিত ছিল পতাকাটি।।
৪. ১৯০৭ সালের পতাকা
১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট মাদাম কামা জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে এক আন্তর্জাতিক সমাজবাদী সম্মেলনে ভারতের হয়ে একটি ত্রিবর্ণ পতাকা উড়িয়ে সকলের নজরে আসেন। পতাকার নাম ছিল সপ্তর্ষি পতাকা। উপরে গেরুয়া মাঝে হলুদ ও নীচে সবুজ। গৈরিকে উপর আঁকা একটি কুসুমের সঙ্গে সাতটি তারা। মাঝে বন্দেমাতরম লেখা ও নীচে সবুজের উপর সূর্য, চন্দ্র।
৫. ১৯০৯ সালের পতাকা
ভগিনী নিবেদিতা এই পতাকার প্রস্তাব করেন। পতাকাটি ছিল লাল রঙের। পতাকার মাঝে ছিল বজ্র, কুসুম ও দন্ড। তার মধ্যে লেখা বন্দেমাতরম। যেহেতু দধিচির হাড় দিয়ে বজ্র তৈরী হয়েছিল, তাই তিনি বজ্রকে ত্যাগের প্রতীক বলে বর্ণনা করেছিলেন। আর ভারতবর্ষের মানুষের মন কসুমের মতো।
৬. ১৯১৬ সালের পতাকা
হোম রুল আন্দোলনের কালে কংগ্রেসের নেতারা মনে করলেন ভারতের জন্য একটি জাতীয় পতাকা গড়া উচিত। মরাঠা নেতা বাল গঙ্গাধর ভিলক এবং অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে একটি নতুন পতাকা তৈরী করা হল।
পতাকাটি ছিল পাঁচটা লাল গ্রবং চারটে সবুজ স্ট্রাইপের। উপরের বাঁদিকের কোনে ইউনিয়ন জ্যাকের সিম্বল। এছাড়া উপরের ডোরায় ছিল সাদা অর্ধচন্দ্র ও তারা। হিন্দুদের পবিত্র সপ্তুর্ষি মন্ডলের প্রতীকরূপী সাতটি সাদা তারা পতাকায় শোভা পেত। এটি ছিল পঞ্চকোনি অর্থ্যাৎ পাঁচ কোনের পতাকা।
৭. ১৯২২-২৩ সালের পতাকা
১৯২২ সালে বিজয়ওয়ারায় কংগ্রেস কমিটি মিটিংয়ে গান্ধীজির উপস্থিতিতে একটি জাতীয় পতাকার প্রস্তাব করা হয়৷ পতাকাটির উপরে ছিল লাল এবং নীচে সবুজ। মাঝে চরকার ছবি ছিল।
পরবর্তীকালে ১৯২৩ সালে কংগ্রেস কমিটির মিটিংয়ে ওই লাল-সবুজ পতাকাটি উল্টে দেওয়া হয়। পরিবর্তে নীচে লাল উপরে সবুজ ও তার উপর সাদা ও মাঝে চরকা আঁকা হয়। লাল এখানে বৃহত্তর হিন্দু ধর্ম যারা সমন্ত ধর্মকে বহন করবে। তাই লাল রঙ নীচে। উপরে সবুজ মানে মুসলিম সম্প্রদায়। ও তার উপরে সাদা মানে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
পতাকাটি ১৯৩০ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়।
৮. ১৯৩১ সালের পতাকা
১৯৩১ সালের ২ এপ্রিল কংগ্রেসের কর্মসমিতিতে সাত সদস্যের একটি নতুন পতাকা সমিতি গঠন করা হল। “পতাকায় ব্যবহৃত রঙ তিনটি নিয়ে আপত্তি আছে, কারণ এই রঙগুলি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে চিহ্নিত’ এই মর্মে একটি প্রস্তাবও সেখানে পাস করা হল। ওই বছর কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম শহরের নিকটবর্তী ভাটলাপেনামারু গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার একটি ত্রিবর্ণর্ভজিত পতাকা স্বীকৃতি পায়। পতাকার উপরে গেরুয়া। মাঝে সাদা। নীচে সবুজ। মাঝে চরকা। চরকা এখানে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক।
৯. ১৯৪৭ সালের পতাকা
১৯৪৭ সালের ২৩ জুন জাতীয় গণপরিষদে একটি পতাকা কমিটি গড়া হয়। ২২ জুলাই গেরুয়া, সাদা এবং সবুজ রঙের তেরঙা পতাকাটিকেই ভারতের স্বাধীন সরকারের জন্য নিদিষ্ট করে। ১৯৪৭ সালের ২২শে আগস্ট চরকার পরিবর্তে সারনাথের অশোক চক্রকে স্থান দেওয়া হয়।