তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা
বাংলার চিরায়ত কথাসাহিত্যের অবিস্মরণীয় এক কালজয়ী রূপকার ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পলেখক। কথাসাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্রের পর যার লেখা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন; তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু কথাসাহিত্যিক হিসেবেই নয়, একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবেও ছিলেন অত্যধিক পরিচিত।
আজ ১৪ সেপ্টেম্বর বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় এই বাঙালি সাহিত্যিকের প্রয়াণদিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে গুণী এই কথাসাহিত্যিকের মৃত্যু হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন।
অন্য আর দশটি সাধারণ বাঙালি সন্তানের মতো তার বেড়ে ওঠা। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কালীপূজা হতো। তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তারা মায়ের দয়ায় জাত বলেই তার নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর। তিনি ছেলেবেলায় মাদুলি, তাবিজসহ নানা সংস্কারের গণ্ডিতে বড় হয়ে ওঠেন। এই সততা, ধর্মভাব, ভক্তি ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। যদিও পরবর্তী জীবনে এসব বিশ্বাস নিয়ে তার মনে অনেক জিজ্ঞাসা ছিল।
লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স পাস করে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখনকার আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধে। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন।
সেখানেই তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। এরপর তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন (১৯৩০)। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। তারপর নিজ গ্রামে চলে যান এবং সাহিত্যসাধনায় আত্ম নিয়োগ করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯৩০ সালে এক বছর কারাবরণ করেন। কারামুক্তির দিনেই তারাশঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেন যে, সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন। ১৯৪০ সালে তিনি স্থায়িভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালে চলে যান বরানগর। তখন পুরো বিশ্বে বেজে চলেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।
১৯৪২ সালে তিনি বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে তাকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি মনোনীত করা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি কানপুরে বসবাসকারী বাঙালিদের দ্বারা আয়োজিত ‘কানপুর বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এ সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। একবার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নির্বাচিত হন তারাশঙ্কর। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’।
তারাশঙ্কর চার দশকের বেশিকাল ধরে সাহিত্য সাধনাতেই ব্রত ছিলেন। এসময়ে তিনি প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পের বই, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনি, ১টি কাব্যগ্রন্থ, ১টি প্রহসন লিখেছেন।
তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালি কলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি।
তার উপন্যাসের প্রধান গুণ মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও জীবন জিজ্ঞাসার গভীরতা। সমাজের ও জীবনের সর্বস্তরের ক্ষয়িষ্ণুতা তার কাছে গভীর বেদনার বাণী বহন করে এনেছিল। ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসটির মূল বিষয় তৎকালীন হিন্দু সমাজের রূপ ও আচার, প্রেম, জীবনসংগ্রাম, মনের বিভিন্ন দিক ইত্যাদি। প্রেম এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। মূলত একটি মানুষকে ঘিরেই উপন্যাসটি আবর্তিত।
‘ডাক হরকরা’ তারাশঙ্করের আরেকটি সেরা গ্রন্থ। রাত্রির বাঁধা উপেক্ষা করে যারা ব্রিটিশ ভারতের কোণায় কোণায় ডাক পৌঁছে দিত, সেসব ডাক-হরকরার সংগ্রামী জীবন নিয়ে লেখা সুকান্তের কবিতা রানার এর আগেই তুলেছি। সেই সূত্র ধরেই একজন ডাক বহনকারীকে নিয়ে লেখা তারাশঙ্করের একটি গল্প। এটি এক নীতিবান ডাক বাহক ও তার দুশ্চরিত্র সন্তানকে নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ গল্প।
তার রচনার বিষয় এবং রচনার চরিত্রগুলোর দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হল গ্রাম্যজীবন ভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনি, আর দ্বিতীয়টা হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনি। জীবনবোধের প্রথম থেকেই রাজনীতির উপস্থিতির কারণেই তিনি ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাস ত্রয় রাজনৈতিক মহাকাব্যিক অনুষঙ্গে লিখতে সমর্থ হন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে।
তার লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে জন্মভূমি বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু।
তিনি নিজে জমিদার বংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহর জীবনের বিকাশ।
সমাজের এ নীরব পরিবর্তন তার রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাদের একজন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নিশিপদ্ম, বিচারক, ফরিয়াদ, কালিন্দী, গণদেবতা, আরোগ্য নিকেতন, রাধারানী, সপ্তপদী, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, কবি, ধাত্রীদেবতা, চাঁপাডাঙার বৌ, নীলকণ্ঠ, জলসাঘর, বেদেনী, হারানো সুর, অভিযান, ডাকহরকরা, পঞ্চপুত্তলী, উত্তরায়ণ, মহানগরী, হীরাপান্না, গুরুদক্ষিণা; রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী, পথের ডাক, কালান্তর; নাটক দ্বীপান্তর, পথের ডাক, দুই পুরুষ।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’, ‘কালিন্দী’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’ ও ‘বেদেনি’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৭), ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬), আরোগ্য নিকেতনের জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৫৫), একই উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৮) উপাধি লাভ করেন।