৩৭০ বিলোপের এক বছর পর কেমন আছে কাশ্মীর?
গত বছর ৫ই আগস্ট কাশ্মীর উপত্যকার অগ্রাধিকার আইন ৩৭০ বিলোপ করেছিল বিজেপি সরকার। সেই সিদ্ধান্তে উত্তাল হয়েছিল গোটা বিশ্ব। বিশ্বের মুসলমান দেশগুলি প্রকাশ্যে ভারতের সমালোচনা করে। আর বন্ধু রাষ্ট্রগুলি দেশের পরিস্থিতি উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা করে।
তারপর কেটে গেছে এক বছর। বিশ্বের কাছে ভারত প্রমাণ করতে চাইছে উপত্যকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। শান্ত। নিরুপদ্রব। দেশ বিদেশের রাষ্ট্রদূতদের দফায় দফায় কন্ডাকটেড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাজোয়া গাড়ির কনভয় সাজিয়ে তাদের দেখানো হচ্ছে মহল্লা, বাজার, রাস্তাঘাট।
আপাত ভাবে কাশ্মীর সত্যিই শান্ত। অতীতে কাশ্মীর যে অশান্তি দেখেছে, ইদানীং তা যে খুব দেখা যাচ্ছে, এমন নয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আগুন যে জ্বলছে, তা বুঝতেও খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। সমস্যা হল, সে কথা কেউ বলতে গেলেই নেমে আসছে শাস্তির খাঁড়া। সকলকে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে হবে। এটাই চাইছে রাষ্ট্র। উল্টো কথা বললেই বিপদ।
বিরোধীদের বক্তব্য, কাশ্মীরে যে শান্তি পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করছে সরকার, তা আসলে কার্ফু, জলপাই উর্দি, বন্দুকের নল আর পেলেট গানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝড়ের আগের নীরবতা।
তবে প্রশ্ন অন্য। গত ৭০ বছরে ৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ সত্যিই কি প্রচুর সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন? সুবিধা যেমন মিলেছে, অসুবিধাও হয়েছে বিস্তর। বস্তুত গত ৭০ বছরে ৩৭০ অনুচ্ছেদেও বহু পরিবর্তন হয়েছে। জম্মু কাশ্মীর বিধানসভার সম্মতিতেই তা ঘটেছে। তবে এত কিছু সত্ত্বেও ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল কাশ্মীরের মানুষের কাছে এক ধরনের সম্মান।
স্বাধীনতার পর্ব থেকেই কাশ্মীরে বার বার গণভোটের দাবি উঠেছে। উপত্যকার মানুষ সে দাবি করেছেন, মহাত্মা গান্ধী সে দাবি তুলেছেন, এমনকী, জাতি সংঘও একাধিকবার সে কথা বলেছে। কিন্তু ৭০ বছর ধরে ভারত এবং পাকিস্তানের সরকার তার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে কাশ্মীরের মানুষ এই বঞ্চনা সয়ে এসেছেন। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল তাঁদের কাছে শেষ রক্ষাকবচ।
ভারত সরকারের দাবি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরেও কাশ্মীর উপত্যকায় কোনও অশান্তি হয়নি। সেখানে সব কিছু স্বাভাবিক। অথচ অগাস্টের পর থেকে দীর্ঘ দিন কাশ্মীর উপত্যকা সাধারণ মানুষের জন্য কার্যত বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দিনের পর দিন সেখানে জারি ছিল কার্ফু।
কাশ্মীর শান্ত রাখার জন্য কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা এবং আধা সেনা পাঠানো হয়েছিল সেখানে। তারা এখনও সেখানে মজুত। গ্রেফতার করা হয়েছে উপত্যকার প্রাক্তন তিন মুখ্যমন্ত্রীকে। গত প্রায় ছ’মাস ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এখন খাতায় কলমে ইন্টারনেট মিললেও লোকে বলছেন, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। বহু সংবাদপত্র বন্ধ। ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। হাসপাতালে কার্যত কাজ হচ্ছে না কারণ, ইন্টারনেট না থাকায় যন্ত্রপাতি আপডেট করা যাচ্ছে না।
বিরোধীদের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়’ এই হল একটি রাজ্যের সার্বিক চিত্র। সরকার বলছে, গত অগাস্টের পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় একটিও গুলি চলেনি। অথচ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি বলছে, হাসপাতাল ভরে গিয়েছে আহত মানুষের ভিড়ে। বাদ নেই শিশুরাও। কোনও রকম প্রতিবাদ করতে হলেই বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে খর্বিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার।
গত ৭০ বছর ধরে বহু ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে কাশ্মীর। অতীত সরকারগুলির বিরুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে বার বার। বলা হয়েছে, গণতন্ত্র রক্ষিত হচ্ছে না উপত্যকায়। আবার একই সঙ্গে আন্দোলনের নামে মৌলবাদী হিংসার চিত্রও দেখেছে কাশ্মীর। দেখেছে সন্ত্রাসবাদীদের তাণ্ডব। ঘটেছে পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থা বিচরণ করেছে দিনের পর দিন। আক্রান্ত হয়েছে মানবতা। গ্রামের পর গ্রাম ভরে গেছে অর্ধ বিধবায়। যে মহিলারা জানেনই না তাঁদের স্বামীরা আদৌ বেঁচে আছেন কি না।
গত এক-দেড় দশকে সেই পরিস্থিতির খানিক বদল ঘটতে শুরু করেছিল। শান্ত হচ্ছিল কাশ্মীর। জঙ্গি আন্দোলনের পরিমাণ কমছিল। খুলছিল আলোচনার পথ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল সেই চিত্রটা ফের বদলে দিয়েছে। ভারত সরকার খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছে বিষয়টি। মুখে যা-ই বলুক, সরকার, প্রশাসন বুঝতে পারছে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সুবিধের নয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাই বিষয়টি নিয়ে কথাই বলতে চাইছে না সরকার। শুনতে চাইছে না সমালোচনাও।
কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে ক্ষত নিরাময় হচ্ছে না। বরং ক্ষত বাড়ছে। কূটনীতি যখন একগুঁয়েমি হয়ে যায়, ইতিহাস বলে তার ফল ভালো হয় না। ভারতে কী হবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে।