প্রিয়জনের মৃত্যু প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথের কবিসত্ত্বাকে
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।
তবুও প্রাণ নিত্যধারা, হাসে চন্দ্র সূর্য তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জ আসে বিচিত্র রাগে।
প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেই। গানের কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবন দিয়ে অনুধাবন করে লিখেছিলেন। তাঁর মতো চোখের সামনে এতগুলো আপনজনের মৃত্যু বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো কবি-সাহিত্যিক দেখেছেন কিনা সন্দেহ।
প্রায় প্রতিটা মৃত্যুই তাঁকে গোড়াশুদ্ধ নাড়িয়ে গেছে, তারপরও তিনি কেমন করে যেন সব ব্যাথা-কষ্ট ছাড়িয়ে সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছেন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমস্ত হাহাকার। না পাওয়ার যন্ত্রণা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রায় আশি বছরের জীবনে পরম স্নেহময়ী মা-বাবা, প্রিয় ভাই-বোন, প্রাণপ্রিয় বৌদি, প্রেমময়ী স্ত্রী, প্রিয়তম ছেলে, মেয়ে, নাতি, ভাইপোসহ আরও অনেক ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুস্থানীয় মানুষের মৃত্যু দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবী যখন মারা যান তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস।
মার মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘প্রভাবে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপর শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না– সেদিন প্রভাবের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।’
তবে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে আরও গভীর করে চিনলেন চব্বিশ বছর বয়সে এসে তাঁর বউঠাকরুন, বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন– ‘আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্র“র মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।’ এ থেকে বোঝা পরবর্তী জীবনে মৃত্যু এসে রবীন্দ্রনাথের বিরহব্যথা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এরপর রবীন্দ্রনাথের পরিবারে মারা যান তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র সন্তান, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এক পত্র থেকে জানা যায় এ-সময় রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী শিলাইদহে ছিলেন। তিনি লেখেন– ‘বলুর মৃত্যু হইয়াছে। কলিকাতায় থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর হইয়াছে। বিশেষতঃ আমার স্ত্রী শিলাইদহে অত্যন্ত শোক অনুভব করিতেছেন, বলুর প্রতি তাঁহার একান্ত স্নেহ ছিল।’
এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় সন্তান নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তিনি লিভার রোগে ভুগছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পুত্রের মতো ভালোবাসতেন। এই মৃত্যুর চার মাস যেতে না যেতেই রবীন্দ্রনাথ হারান তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে, তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে। এই মৃত্যুর পরপরই তিনি নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যই হোক আর সত্যি সত্যি অনুভব করেই হোক ব্রজেন্দ্রকিশোর দেবমাণিক্যকে লিখেছিলেন– ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়েছেন সেই শোককে তিনি নিষ্ফল করিবেন না– তিনি আমাকে এই শোকের দ্বার দিয়া মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়ে দিবেন।’
এই মৃত্যুর এক বছর অতিক্রম করার আগেই রবীন্দ্রনাথ হারান তাঁর প্রাণপ্রিয় মেজো মেয়ে রেণুকা দেবীকে। এটাই ছিল কবির প্রথম সন্তানশোক। রেণুকা যক্ষ্মায় ভুগছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ হারান পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতাকে আদর্শ মানতেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের হাল ধরেন তিনি। পিতার মৃত্যুর বছর দুয়েক পূরণ হওয়ার কিছু আগে রবীন্দ্রনাথ হারান তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
শমীন্দ্রনাথ মারা যান কলেরায়।
এই মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে শোকপ্রকাশ করা প্রায় পরিত্যাগ করলেন। ধরে নেওয়া হয়, এই মৃত্যুর পরপরই তাঁর ভেতর মৃত্যুবিষয়ক এক আধ্যাত্মিক চিন্তা পাকাপাকি ভাবেই আবাস গাড়ে। এজন্যই তিনি কাদম্বিনী দত্তকে লিখতে পারলেন– ‘ঈশ্বর আমাকে বেদনা দিয়াছেন কিন্তু তিনি ত আমাকে পরিত্যাগ করেন নাই– তিনি হরণও করিয়াছেন পূরণও করিবেন। আমি শোক করিব না– আমার জন্যও শোক করিয়ো না।’
এরপর রবীন্দনাথ তাঁর পরিবার থেকে হারান বড় মেয়ে মাধুরীলতা দেবী, জ্যোষ্ঠ ভ্রাতা সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রিয় বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান এরপরেই। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান তারপর। এরপর রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিবার থেকে আরও হারান তাঁর একমাত্র নাতি নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ভাই গুণেন্দ্রনাথের পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দাদা সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে শাণিত করেছে সৃষ্টিপথে, নির্মহ করেছে জগৎসংসারে, নস্টালজিক করেছে ক্ষণে ক্ষণে। তাই তো তিনি গাইতে পেরেছেন প্রাণখুলে–
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা?/ ওই-যে সুদূর নীহারিকা/ যারা করে আছে ভিড়/ আকাশের নীড়,/ ওই যারা দিনরাত্রি/ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী/ গ্রহ তারা রবি,/ তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?…