রাজ্যে আক্রান্তের চেয়ে সুস্থের সংখ্যা বেশি
রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার অভিমুখ বদলে দিল সোমবার তিন চিকিৎসকের মৃত্যু। কারণ, তিন জনই আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত রোগী পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
চিকিৎসক সংগঠনগুলি সূত্রে খবর, রাজ্যে এ পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২০ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু অগস্টে মৃত্যু হয়েছে ন’জনের। এ দিন প্রথম কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারের কার্ডিয়োলজিস্ট তপন সিংহের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে খবর আসে, করোনা আক্রান্ত হয়ে শ্যামনগর অঞ্চলের জনপ্রিয় চিকিৎসক প্রদীপ ভট্টাচার্য (৫৬) এবং চক্ষুরোগের চিকিৎসক বিশ্বজিৎ মণ্ডলও (৬২) মারা গিয়েছেন। এ ছাড়া, সন্ধ্যায় জানা যায়, বর্ধমানের একটি কোভিড হাসপাতালে প্রাক্তন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, ৮৮ বছরের প্রবীণ চিকিৎসক পি সি দে’র মৃত্যু হয়েছে।
এ দিন স্বাস্থ্য দফতরের তরফে প্রকাশিত বুলেটিনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৯০৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। বস্তুত, গত তিন দিন ধরে দুই মাপকাঠিতেই রাজ্যের পরিসংখ্যান নিম্নমুখী রয়েছে। বস্তুত, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। এ দিনের বুলেটিনে জানানো হয়েছে, গত চব্বিশ ঘণ্টায় সারা রাজ্যে ২৬২৯৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এ দিন একদিনে ৩২০৮ জন আক্রান্তকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। সেটিও এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে আক্রান্তের তুলনায় সুস্থের সংখ্যা এ দিন বেশি। যা যথেষ্ট আশাপ্রদ। তবে পাশাপাশি, চিকিৎসকদের মৃত্যুতে উদ্বেগ বাড়ছে।
কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টার সূত্রের খবর, চিকিৎসক হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ‘শহিদ’ হয়েছেন তপনবাবু। এই মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করে হাসপাতালের এক আধিকারিক জানান, কোভিড রোগীর ইকোকার্ডিয়োগ্রাম করানো প্রয়োজন। কিন্তু করোনা ওয়ার্ডে কেউ যেতে চাইছেন না দেখে পিপিই পরে নিজেই যন্ত্র নিয়ে চলে যেতেন তপনবাবু।তাঁর বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসক হিসেবে এই দায়বদ্ধতার জন্যই অনেক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।’’ গত ১০ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে কোঠারিতে দিন তিনেক ভর্তি থাকার পরে তপনবাবুকে অ্যাপোলোতে স্থানান্তর করে তাঁর পরিবার। প্রায় মাসখানেক সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পরে এ দিন সকালে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এনআরএসের প্রাক্তনী প্রদীপ ভট্টাচার্য শ্যামনগরের বাসিন্দাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। গভীর রাতেও ডাক্তারবাবুকে ডাকলে পাশে পাওয়া যেত বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। সপ্তাহ তিনেক মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরে এ দিন তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। চক্ষুরোগের চিকিৎসক বিশ্বজিৎ মণ্ডলও ব্যারাকপুর অঞ্চলে আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত রোগী দেখা বন্ধ করেননি বলে খবর। কুড়ি দিনের বেশি চিকিৎসাধীন থাকার পরে আনন্দপুরের বেসরকারি হাসপাতালে এ দিন দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।
অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার বক্তব্য, একের পর এক চিকিৎসকের মৃত্যু রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি জানান, রোগীকে পরিষেবা দেওয়া চিকিৎসকের কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতেই পারেন। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁরা উন্নতমানের চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন সেটা সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বেড জোগাড় করতে গিয়ে চিকিৎসায় সময় নষ্ট হয়েছে, এটা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও সত্যি। নিরুপায় হয়ে অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সেখানকার বিপুল খরচ পরিবারগুলির উপরে আর্থিক চাপ তৈরি করছে।’’ সব মিলিয়ে চিকিৎসকদের পরিবারের উপর মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে বলে মত চিকিৎসক সংগঠনগুলির। এর ফলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের কেউ কেউ ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে মত একাধিক চিকিৎসক সংগঠনের।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সম্পাদক কৌশিক চাকী জানান, চার মাসেও চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী-সহ প্রথম সারির করোনা যোদ্ধাদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করা গেল না, এটা দুর্ভাগ্যজনক। কোভিডে মৃত প্রথম দুই চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ এখনও পর্যন্ত কেন ক্ষতিপূরণ পাননি সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। সম্প্রতি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তরুণ চিকিৎসক নীতীশ কুমারের। এ দিন কৌশিকবাবু জানান, ওই চিকিৎসকের স্ত্রী এখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। দু’বছরের পুত্রসন্তানও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
ডক্টরস ফর পেশেন্টের তরফে চিকিৎসক শারদ্বত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যুদ্ধে জওয়ানের মৃত্যু হয়। তার জন্য লড়াই হারার প্রশ্ন নেই। কিন্তু চিকিৎসক-সহ প্রথম সারির যোদ্ধারা যাতে নিশ্চিন্ত মনে লড়াইটা করতে পারেন সেটা রাজ্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।’’ এ দিন স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম অবশ্য সেই আশ্বাসই দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘চিকিৎসক-সহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পৃথক হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হবে।’’ আর ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখার সম্পাদক শান্তুনু সেন বলেন, ‘‘চিকিৎসকেরা কোভিড আক্রান্ত হলে তাঁদের দেহে ভাইরাল লোডের পরিমাণ অনেক বেশি থাকছে। ফলে দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। রোগী দেখার সময় চিকিৎসকদের আরও সতর্ক হতে হবে।’’
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)