নেতাজির অন্তৰ্ধানকে মূলধারার আলোচনায় ফিরিয়েছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়
ইতিহাস লেখে জয়ীপক্ষই, চিরকাল এমনটাই হয়ে এসেছে। স্কুলে আমাদের যে ইতিহাসের বই পড়ানো হয়, তাতে প্রতিফলিত হয় সেই সময়কার শাসকদলের রাজনৈতিক মতবাদ। বাস্তবে অতীতে কী ঘটেছে তার বিবরণ কী আমাদের তা অজানাই থেকে যায়। তাই তো ইতিহাস ভেঙে তৈরি করা হয় নতুন নতুন নায়ক। এবং প্রকৃত নায়কদের কথা মানুষ ভুলে যায়।
সুভাষচন্দ্র বসু আমার মতো অনেকের কাছে একজন আইকন। আমরা সকলেই জানি যে তিনি কতটা সাহসীভাবে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং একটি স্বাধীন ভারত গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। তবে তাইহোকু ‘বিমান দুর্ঘটনার’ ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না তিনি সত্যিই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, নাকি অন্তরালে থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি দুর্দান্ত চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন।
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে তিনি সম্ভবত এই দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছিলেন (বা এমন কোনও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি), তাহলে তারপর কি হল? তিনি কি সন্ন্যাস নিয়ে সাধুবেশে ভারতে ফিরে এসেছিলেন? নাকি তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে গেছিলেন, যেখানে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল? নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এখনও মানুষ বিভক্ত। আজ অবধি আমরা এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ পাইনি যা প্রশ্নাতীতভাবে বলতে পারে নেতাজির মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল।
এই প্রেক্ষিতে, সৃজিত মুখার্জির ছবি গুমনামি শুরু থেকেই বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছিল। বসু পরিবারের কিছু সদস্য এই ছবির নাম নিয়ে আপত্তি তোলেন, সোচ্চার হন প্রতিবাদে। আদালতে মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু, মহাকালের কৃপায় সমস্ত বাধা অতিক্রম করে গত বছর পুজোয় মুক্তি পায় এই ছবি। আলোড়ন তোলে জনমানসে।
‘এক জে ছিল রাজা’-র মতো গুমনামি একটি কোর্ট রুম ড্রামা। নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ স্টাইলে পরিচালক চিত্রনাট্য লিখেছেন। নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচন করতে যে মুখার্জি কমিশন গড়া হয়েছিল, তারই শুনানির ওপর ভিত্তি করে এই গল্প রচিত। মিশন নেতাজি-র কর্ণধার চন্দ্রচূড় ধর (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) এবং সাবেকি নেতাজি গবেষক পালবাবুর (বিপ্লব দাশগুপ্ত) বাকবিতণ্ডা ও উত্থাপিত তথ্যাদির মাধ্যমে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যে আলো ফেলতে চেয়েছেন পরিচালক।
চন্দ্রচূড়ের দৃঢ় বিশ্বাস, নেতাজি ভগবানজী (গুমনামি বাবা) রূপে ভারতে ফিরে এসেছিলেন। অন্যদিকে ইতিহাসবিদ পালবাবু বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই দুটি চরিত্রের মধ্যে মৌখিক দ্বন্দ্ব খুবই মনোগ্রাহী। চন্দ্রচূড়ের বেশ কিছু সংলাপে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন পরিচালক। ‘স্বাধীন ভারতে সকলের পদবী বোস’ কিংবা, ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই – এই সংলাপে থিয়েটার জুড়ে হাততালি ছিল দেখার মত।
কোনও সন্দেহ নেই, এই ছবির প্রাণের স্পন্দন অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয়। নেতাজির প্রতি চন্দ্রচূড়ের আবেগ মন ছুঁয়ে যাবে। চন্দ্রচূড়ের নেতাজি-সিনিক থেকে নেতাজি-অনুরাগী হয়ে ওঠার যে উত্তরণের গল্প, সেটি বাস্তবতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন সৃজিত। নেতাজির ভূমিকায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এক চমকই বটে। দেশনায়কের চিত্রায়ণে তিনি প্রকৃতপক্ষেই সাবলীল। তনুশ্রীও চন্দ্রচূড়ের স্ত্রীর ভূমিকায় ঝকঝকে।
সোমনাথ কুন্ডুর ‘প্রায় বাস্তব’ মেকআপ নেতাজিকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলেছে। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের আবহ সঙ্গীত ও সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ (বিশেষত সাদাকালো দৃশ্যগুলি) গল্পে প্রাণ সঞ্চার করে। ড্রোন ব্যবহার শ্রীজিত মুখার্জির একটি বৈশিষ্ট্য এবং তিনি এখানেও অসাধারণ। ফৈজাবাদে শেষকৃত্যের দৃশ্যটি চোখে জল আনবেই।
তবে ছবির কিছু খামতির দিকও রয়েছে। নেতাজির রাশিয়া যোগ সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য নেই ছবিতে। শেষের দিকে চিত্রনাট্য একটু বেশি অতিরঞ্জিত, মেলোড্রামাটিক। মধ্যরাতের ডাইনিং টেবিল দৃশ্য কিংবা চন্দ্রচূড়ের স্ত্রীর সাথে মিটমাট – ছবিতে খুবই অপ্রয়োজনীয় সংযোজন ছিল। তদুপরি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে ‘মিশন নেতাজি’ এর প্রচার।
পরিশেষে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ছবিটি কোনও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচার করে? না, অন্তত আমার তা মনে হয়নি। ছবিতে নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে শেষপর্যন্ত কোনও তত্ত্বকে মান্যতা দেওয়া হয়? কিছুটা হলেও হ্যাঁ। ছবিটি মুখার্জি কমিশনের শুনানির ভিত্তিতে নির্মিত। সুতরাং, কমিশনের চূড়ান্ত রায়টি ফিল্মের রায়, একটি ছোট্ট ক্যাভিয়েট সহ।
সব বিতর্কের উর্দ্ধে গিয়ে একটা কথা না বললেই নয়। এর আগে ভারতে নেতাজিকে নিয়ে এইরকম কাজ হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষের এই প্রতিদান প্রাপ্য ছিল। তার অন্তর্ধান রহস্যকে ধামাচাপা দেওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আজ আবার তা লোকমুখে ফিরে এসেছে। আলোচনা হচ্ছে দেশনায়ককে নিয়ে। স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর, নেতাজির প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কি হতে পারে। এবং এই অসাধ্যসাধন করার কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের।