বিতর্ক সামলে এমন ‘Well Reserched’ ছবি দর্শকদের দিয়েছিলেন পরিচালক
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের বিতর্কিত “গুমনামী” দেখে প্রথমেই পরিচালককে ধন্যবাদ দিতে হয় এরকম একটা ‘Well Reserched’ ছবি তৈরী করার জন্য। গল্পটা মোটামুটি সকলেরই জানা। ছবির পোস্টারেই বড় বড় করে লেখা: “Based on Mukherjee Commission Hearings”। কিন্তু এই ছবি ঠিক যতটা নেতাজী ও তাঁর অন্তর্ধান রহস্য এবং ‘গুমনামী’ বাবার আসল পরিচয় ঘিরে আবর্তিত, ঠিক তেমনটাই আমার আপনার মত একজন সাধারন মানুষ যে কিনা পেশায় সাংবাদিক, তেমন একটি মানুষের লড়াইয়ের গল্প। চন্দ্রচূড় ধর (অনির্বান ভট্টাচার্য)। ইনি এমন একজন মানুষ, যে কিনা নেতাজীকে ওভাররেটেড বলে মনে করে, মনে করে নেতাজী কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে না গেলে হয়তো সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে পারতেন। কিন্তু এই মানুষটিই নেতাজীকে নিয়ে টানা ছ বছর পড়াশোনা ও গবেষণা করে শেষমেষ তার ধারনা সম্পূর্ণ বদলায়। আমার আপনার মতনই একজন সাধারন মানুষ যে কিনা শুধুমাত্র নেতাজীকে জানার নেশায় এবং বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক রহস্য সমাধানের আশায় নিজের সুখের চাকরি সংসার সবকিছু ছেড়ে দিতে পারেন সেই মানুষটার গবেষণা ও যা থেকে পৌঁছানো সিদ্ধান্ত আদৌ ধোপে টিকবে কিনা এবং না টিকলে সেই মানুষটি কোনোরকম রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে একটা সত্যিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে- সেই লড়াইয়ের গল্পও শোনায় এই ছবিটি।
সবচেয়ে বড় কথা, ছবিটিতে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া অংশ প্রায় নেই বললেই চলে। গোটা সিনেমাতে একবারের জন্য কোথাও বলা হয়নি যে নেতাজী এবং গুমনামী বাবা আদতে একই মানুষ। কিন্তু সম্ভাবনাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। ছবিটিতে সস্তা দেশপ্রেমের কচকচানি নেই, প্রতি মিনিট অন্তর অন্তর একটি দেশাত্মবোধক গান লাগিয়ে দর্শককে আবেগঘন করার ব্যর্থ চেষ্টা নেই।
আর বাকি থাকলো অভিনেতাদের কথা। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথা আর কি বলা যায়- বহু বছর উনি এমন ভাবে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে একাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ওনার কাছ থেকে এমন অভিনয় যথেষ্ট অভিপ্রেত। শুধুমাত্র ওনার জন্য এবং শেষের জনগণমন গানটির জন্যই গোটা সিনেমাটা আবার দেখা যায়। আর বাকি মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, চন্দ্রচূড় ধরের ভূমিকায় যথেষ্ট স্বতন্ত্র এবং নিজের ছাপ ফেলতে সক্ষম। এছাড়া চন্দ্রের স্ত্রীর ভূমিকায় তনুশ্রীও যথেষ্ট সাবলীল। ইন্ডিয়া টাইমসের সম্পাদক হিসেবে সৃজিৎ মুখার্জীর ক্যামিওটাও যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ছবির গল্পটি কোনও প্রত্যাশিত সমাপ্তিতে পৌঁছায় না, বরং বলা ভাল সমাপ্তিতে পৌঁছতে চায় না। বরঞ্চ দর্শকদের মনে একটা প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। কেন এখনও নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য সম্পর্কে দেশের কোনও সরকার কোনোদিনও মুখ খুলতে চাননি? কেন উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চন্দ্রচূড় ধর এবং তাঁর “মিশন নেতাজী”র সমস্ত সাক্ষ্যকে এভাবে টিকতে দেওয়া হল না? যাই হোক, তবু এসব বিতর্কের বাইরে সৃজিৎ মুখার্জির এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট শেষবারের মতো প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে। নথিপত্র হিসাবে তাইওয়ানে একটি বিমানে ভ্রমন করছিলেন তিনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চলন্ত অবস্থায় ভেঙে পড়েছিল সেই বিমান, অথচ বিমানের ধ্বংসাবশেষ অথবা নেতাজীর দেহ উদ্ধার করা যায় নি কখনো। তারপর থেকেই তার মৃত্যু এবং অন্তর্ধান নিয়ে রহস্য জমাট বাঁধে। সেই সময় অনেকেই বহুবার দাবী করেছিলেন, বেঁচে আছেন নেতাজী। কিন্তু কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেন নি। পাশাপাশি, তাঁর মৃত্যুর প্রমাণও পাওয়া যায় নি আজ পর্যন্ত।
জানা গেছে ‘গুমনামি’ সিনেমার লুকের জন্য বেশ ঝুঁকি নিতে হয়েছে প্রসেনজিতকে। ওজন বাড়ানো থেকে প্রস্থেটিক মেকআপ, প্রায় ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমের পর এই চেহারা তৈরী হয়েছে। আর এই অসাধ্য সাধন করেছেন মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডু।
উল্লেখ্য সৃজিতের ‘গুমনামি’ সিনেমাটি অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষের লেখা বই ‘কোনানড্রাম’ থেকে অনুপ্রাণিত। কথিত, ১৯৭০ সাল নাগাদ উত্তর প্রদেশে আর্বিভাব ঘটে গুমনামি বাবার। একাংশের মতে, এই বাবাই আসলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। তাঁর সঙ্গে নেতাজীর আদলের নাকি মিল পাওয়া গিয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু চিঠিপত্রও তাঁর কাছে ছিল বলে জানা যায়। তবে কোন কিছুতেই রহস্যের মীমাংসা হয়নি।