“মমতার আমলে জঙ্গলমহলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে” – অকপট ছত্রধর মাহাত
২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত লালগড় আন্দোলনের মুখ ছিলেন ছত্রধর মাহাত। তিনি যখন কারাবন্দি হয়েছিলেন তখন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। ১১ বছর কারারুদ্ধ থাকার পর মাত্র মাস কয়েক আগে তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। আর ছাড়া পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের কমিটিতে মিলেছে ঠাঁই।
ছত্রধর মাহাত মুখোমুখি হয়েছিলেন দৃষ্টিভঙ্গির। রইল তাঁর এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার:
দৃষ্টিভঙ্গি: ২০০৮-এর নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশি সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে জনসাধারণের যে কমিটি ছিল সেখানে আপনি মুখপাত্র ছিলেন। তৎকালীন শাসক দল সিপিএম বলেছিল তৃণমূলের সাথে মাওবাদীর আঁতাত আছে। এখন আপনি জেল থেকে বেরিয়ে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক। কি বলবেন?
ছত্রধর: আমি এই পার্টিটার জন্ম লগ্ন থেকেই ছিলাম। পরবর্তী কালে এই এলাকার সমস্যা এবং এলাকার মহিলাদের ওপর অত্যাচারের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষ গর্জে উঠেছিল। আমি তার নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। এটা একটা ইতিহাস। তৎকালীন সরকার এই জনজাতির আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। তারা পুলিশ দিয়ে এই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসবাদী, মাওবাদী বলে আখ্যা দিয়েছে। বিশেষ করে আমাকে। জেলবন্দীও করেছে। এ এক ইতিহাস। আজ ১১ বছর পর প্রমাণিত যে সেই আন্দোলন ছিল এই এলাকার আর্ত সামাজিক আন্দোলন। বর্তমান সরকার তা অনেকখানি পুষিয়ে দিয়েছে।
আপনারা যখন ২০১১-র আগে এসেছেন, তখনকার অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা নিশ্চই প্রত্যক্ষ করছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকের লালগড়কে আপনারা চিনতে পারবেন না। ২০১১-র আগের লালগড় আর বর্তমানের লালগড় আকাশ- জমিন ফারাক। আমি মনে করি সেই সরকার যারা আমি সহ আমার সহযোদ্ধাদের বিরূদ্ধে দমন-পীড়ন করেছে। কেস দিয়েছে, ইউএপিএ লাগিয়েছে। এখন তারা সরকার থেকে সরে যাওয়ার পর ইউএপিএ-র বিরূদ্ধে মিছিল করছে। কালা কানুন বলছে।
আপনারা দেখেছেন ভাঙরের আন্দোলনের পর, বামফ্রন্টের শরিক দলেরা, মূলত সিপিএম-র সব থেকে বড় নেতা বিমান বসু রাস্তায় নেমে হুংকার তুলেছিলেন যে ইউএপিএ কালা কানুন মানছি না, মানব না। অথচ এরাই যখন সরকারে ছিল এরা আমাদের বিরূদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করেছে। সাধারণ মানুষের ন্যুনতম দাবিকে বুটের তলায় পিষে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে। মানুষের ওপর অত্যাচার করে তাদের জেলে ভরেছে।
তার ফলও তারা পেয়েছে। বর্তমানে ২০১১ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরে এই এলাকার আর্ত সামাজিক সমস্যা অনেকখানি মিটেছে। রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রতিটা জায়গাতেই তারা উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেই উন্নয়নে জঙ্গল মহলের আদিবাসীরাও সামিল হয়েছেন।
দৃষ্টিভঙ্গি: আপনি জঙ্গল মহলের পরিবর্তনের কথা বললেন, একটা বিষয় জানতে চাইব যে, যে সময় আপনি জনসাধারণ কমিটির মুখপাত্র ছিলেন, সেসময় আপনার সাথে হাজারে হাজারে মানুষ হাঁটতেন, কিন্তু যখন ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আপনি নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মাত্র ২০ হাজার ভোট এসেছিল। কি বলবেন?
ছত্রধর: আমি নির্বাচনে জেতার জন্যে দাঁড়াইনি। যারা আমাকে নৈরাজ্যবাদী, সন্ত্রাসবাদী বলেছিল তাদের প্রমাণ দিতে চেয়েছিলাম আমি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটে অংশ নেওয়ার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। সেই জায়গা থেকেই আমি নমিনেশান জমা দিয়েছিলাম। ভোটে জিতে আমি এমএলএ হব এরকম মনোভাব নিয়ে নমিনেশান ফাইল করি নি।
দৃষ্টিভঙ্গি: একটা সময় অনেকেই বলতেন জননেতা ছত্রধর মাহাত। এখন তারা বলছেন, শাসকদলের নেতা হয়ে গেছে ছত্রধর। কি বলবেন?
ছত্রধর: গণতান্ত্রিক দেশে একটা শাসক তো থাকবেই। কোন না কোন দল শাসক হিসাবে আসবেই। শাসক দলের কাজে আমি যদি সন্তুষ্ট হই, তার সাথে সামিল হতে আপত্তি কোথায়? যে সরকার শাসন করছে, সেই সরকারের কাজের যে মূল্যায়ন, এই এলাকায় যে উন্নয়ন তারা এনেছে, মানুষের অভাব- অভিযোগ মেটাচ্ছে এটাই তো মূল বিষয়। মানুষের সাথে থেকে, মানুষের উন্নয়ন এটা সবাই চায়।
দৃষ্টিভঙ্গি: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কোন কোন বৈশিষ্ট্য আপনাকে অনুপ্রেরণা দেয়?
ছত্রধর: মমতা বন্দোপাধ্যায় এক কথায় মহান। নব্বইয়ের দশক থেকে তাঁর সাথে পরিচয়। তখন এতো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। পরবর্তীতে যখন তিনি দল গঠন করেন, তখন ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি জঙ্গল মহলকে সবার থেকে আগে দেখেন এবং জঙ্গল মহলের মানুষের ওপর তিনি আস্থা রাখেন। সে কারণেই আমি জেল থেকে বেরনোর ৬-৭ মাসের মধ্যে তিনি আমাকে এরকম একটা দায়িত্ব দিয়েছেন। এই সম্মান আমার একার নয়, সারা জঙ্গল মহলের আদিবাসী মানুষের সম্মান। তিনি যেমন এখানের উন্নয়ন করেছেন, সেভাবেই এখানকের মানুষদের সম্মানটাও দেন।
এখানে অনেক ছোট ছোট জনগোষ্ঠী, জাতি আছে, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা আছে, তিনি প্রত্যেককের প্রতি সহানুভূতিশীল। লালগড়ের অলচিকি ভাষায় তিনি স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কুরমি সমাজের নিজস্ব ভাষা আছে, তাদেরও নিজস্ব হরফ তৈরি করেছে। আমি মনে করি আমরা যদি দিদির কাছে যাই, দিদি নিশ্চই তাদের ভাষাকেও স্বীকৃতি দেবে। তাদের জন্যে আলাদা পর্ষদও তৈরি করেছেন। সবাই স্বীকৃতি পাবে। জঙ্গল মহলের জনজাতির প্রতি দিদির যথেষ্ট টান আছে, তাই তিনি বার বার এখানে ছুটে আসেন। দিদির এই গুনগুলোই আমাকে আকৃষ্ট করে।
(চলবে)