১৪৪ বছর আগে আজকেই চালু হয়েছিল উত্তরবঙ্গের রেল পরিষেবা
১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দ। দিনটি ছিল ২৮ শে আগস্ট। কালো ধোঁয়া উড়িয়ে উত্তরবঙ্গের বুক চিরে ছুটে চলেছে এক যন্ত্র দানব আর সেই দানবের পেটের ভিতর সওয়ার তৎকালীন বাংলার ছোটলাট স্যার রিচার্ড টেম্পল। সেই ট্রেন এসে থামল জলপাইগুড়ি শহরে তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের সদর দপ্তরে। ঘটনাটা শুধু এটুকুই হলে অন্য কথা হতো কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তরবঙ্গের মাটিতে সেটাই ছিল প্রথম রেলযাত্রা ।
১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে দক্ষিণবঙ্গে প্রথম রেল চলে হাওড়া থেকে হুগলী এবং এর প্রায় ১০ বছরের মধ্যেই দক্ষিণবঙ্গ রেলপথে ছেয়ে যায় কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে তা অধরাই ছিল। অবশেষে প্রায় ২২ বছর পরে উত্তরবঙ্গে প্রথম রেলের চাকা গড়ায় আজকের দিনে । ১৪৪ বছর আগে আজকের দিনে বাংলার ছোটলাট স্যার রিচার্ড টেম্পল কে নিয়ে আত্রাই থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত যে রেলগাড়ি এসেছিল তা উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।
উত্তরবঙ্গে দ্রুত রেলপথ বিস্তারের পিছনে যে ব্যক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি হলেন স্যার রিচার্ড টেম্পল । ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলার গভর্নর ( ছোটলাট) পদে আসীন হন । ওই বছরেই বার্মা থেকে চাল এনে বিহারের দুর্ভিক্ষ ভালোভাবে মোকাবিলা করেন । তখন দূর্ভিক্ষ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার , আর উত্তরবঙ্গ প্রায়শই দুর্ভিক্ষ হত । তাই খাদ্যশস্য পরিবহনের জন্য উত্তরবঙ্গে রেলপথের প্রয়োজন পড়ে । এই রেলপথ স্থাপনের তাৎক্ষণিক কারণ সম্পর্কে রাধারমণ মিত্র তার ‘কলকাতা দর্পণ’ বইতে লিখেছেন , ‘১৮৭৫-৭৬ সনে উত্তরবঙ্গে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয় দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য সরকার রেলপথ খোলেন’।
এ ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সাহেবদের গ্রীষ্মনিবাস দার্জিলিং শহরের সঙ্গে কলকাতার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর আগে কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়া রীতিমতো কষ্টকর বিষয় ছিল । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেলপথের সাহিবগঞ্জ পৌঁছে সেখান থেকে ৪ ঘন্টা নৌপথে কারাগোলা ঘাট যেতে হত । তারপর সড়কপথে পূর্ণিয়া , কিষাণগঞ্জ, তেতুলিয়া , শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং যেতে হতো । এতে খরচাও ছিল প্রচুর।
উত্তরবঙ্গে রেলপথ পাতার জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের কোম্পানি’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেন । ১৮৭১-৭২ খ্রীস্টাব্দে এই রেলপথের সার্ভের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে ভেড়ামারা ঘাটের অপর পাড়ে থাকা সাঁড়া ঘাটের নিকট হতে শিলিগুড়ি অবধি ২০৪ মাইল দীর্ঘ মিটার গেজ রেলপথের কাজ শুরু হয় ।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্র দিন যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে এই রেলপথের প্রায় ১৩৫ মাইল অংশ, আত্রাই থেকে জলপাইগুড়ি অবধি খুলে দেওয়া হয় ছোট লাটের যাত্রার মাধ্যমে । এই রেলপথ চালু হওয়ার ফলে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি রেলপথে যুক্ত হয় । তবে এই পথেও একটি ঝক্কি ছিল ,কলকাতা থেকে ট্রেনে দামুকদিয়া ঘাটে এসে স্টিমারে নদী পার করে আবার সারা ঘাট থেকে মিটারগেজ ট্রেনে চেপে জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি আসতে হতো । ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ (সারার পুল) চালু হলে ফেরী পারাপারের ঝামেলা বন্ধ হয় কিন্তু সান্তাহারে ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজ ট্রেন বদলের ঝক্কি আরো দশ বছর পোহাতে হয়ে হয়েছিল ।
অবশেষে ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে পার্বতীপুর – শিলিগুড়ি মিটার গেজ রেলপথের গেজ পরিবর্তন করে ব্রডগেজ রেলপথ চালু হলে কলকাতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয় । শিয়ালদা থেকে সরাসরি দার্জিলিং মেলে চেপে তখন জলপাইগুড়ি আসা যেত। সেই সময় দার্জিলিং মেল ছিল ৯ কোচের। মোট শ্রেণি ছিল চারটি । প্রথম শ্রেণীতে ৫৯ জন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৬৩ জন , ইন্টার ক্লাসে ১০৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ১৫৮ জন যাত্রীর স্থান থাকত । মোট ৩৮৪ জন । ২,৪৫,০০০/- টাকা ব্যয়ে কাঁচরাপাড়া রেলকারখানায় নির্মিত এই ট্রেনটি তৎকালীন ভারতের দ্রুতগামী ট্রেন ছিল যা ঘন্টার ৫০ মাইল বেগে চলাচল ছুটতে সক্ষম ছিল । ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের সময়সারণী থেকে জানা যায় বিট্রিশ আমলে ১ আপ / ২ ডাউন দার্জিলিং মেলে জলপাইগুড়ি – কলকাতা যাতায়াতে সময় লাগত মোটামুটি ১২ ঘন্টা।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে “বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে কোম্পানি” জলপাইগুড়ি শহরের তিস্তার অপরপাড়ে অবস্থিত বার্নেস ঘাট থেকে ডামডিম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ পত্তন করেন চা পরিবহনের জন্য । এই চা তিস্তা পার করে কলকাতা পাঠানোর জন্যই জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ১ মাইল দীর্ঘ রেললাইন পাতা হয় তিস্তার পাড় অবধি । বর্তমানের কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রের নিকটে “জলপাইগুড়ি ঘাট” বলে একটি স্টেশন ও তৈরী করা। তবে এই শাখালাইনের স্থায়িত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে বার্ণেস থেকে লালমনিরহাট রেললাইন পাতা হলে এই লাইনের গুরুত্ব কমে যায় এবং এক দশকের মধ্যেই এই লাইনটি পরিত্যক্ত হয়। এর ফলে জলপাইগুড়ি স্টেশন তার জংশন তকমা হারিয়ে ফেলে ।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগের ফলে কলকাতা যাওয়ার প্রধান লাইন পাকিস্তানের চলে গেলে জলপাইগুড়ি স্টেশন তার গুরুত্ব হারায় । শেষমেষ ৬০ এর দশকের শেষের দিকে “জলপাইগুড়ি রোড” স্টেশন তৈরী হলে এই স্টেশনের গৌরবের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয় ।। প্রায় সার্ধ-শতবর্ষ প্রাচীন উত্তরবঙ্গের প্রথম টার্মিনাল স্টেশনের গুরুত্ব এখন আর নেই বললেই চলে ।। আজকের দিনের একসময় যে স্বর্ণযুগের শুরু হয়েছিল তা আজ প্রায় অস্তমিত।
লেখক: জয়দীপ রায় (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
তথ্যসূত্রঃ
১. ” Concise History Of Darjeeling District Since 1835″ – written by E C Dozey
২. “History of Indian Railway – Construction & Progress” – by Railway Department (Rail Board)
৩. “দার্জিলিং-এর টয়ট্রেন – একাল ও সেকাল” লেখক অরুণাভ দাস