‘মামাবাবু’-র প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন ঢাকুরিয়া
ঢাকুরিয়ার ‘বাতায়ন’-এ আর পড়বে না প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পা। লেক রোড এলাকায়, ৬০/২/৭ কবি ভারতী সরণীর বাড়ির বাসিন্দাকে হারিয়ে শোকাহত ঢাকুরিয়া।
অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকদিন ধরেই। ঈশ্বরের কাছে সকলেই প্রার্থনা করছিলেন, যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন প্রণববাবু। কিন্তু বর্ণময় এই রাজনৈতিক চরিত্রের জীবন থেমে গেল ৮৪ বছরে। সোমবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরই ঢাকুরিয়ার বাড়ির সামনে আসতে থাকেন এলাকার বাসিন্দারা। সামনে থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ নেই। তাই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই ‘মামাবাবু’র প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন তাঁরা। বাবলু হালদার, শিবু নস্করদের কাছে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘মামাবাবু’। বাবলু জানালেন, বস্তি এলাকায় ব্রিজের পাশে আমার দোকান। মামাবাবুর সহযোগিতাতেই এই দোকান আজও চালিয়ে যেতে পারছি। বাবলুর স্ত্রী বৃহস্পতি হালদারের কথায়, প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হন বা মন্ত্রী, তিনি আমাদের কাছে ছিলেন নিজের মামা মতো। রক্তের সম্পর্ক নেই, কিন্তু মনে হচ্ছে পরিবারের এক সদস্যকে হারালাম। ঢাকুরিয়ার বাড়ির পাশেই যুবক সঙ্ঘ ক্লাব। তার ধার ঘেঁষে শনি মন্দির। বাড়ি থেকে হেঁটে শনি মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন প্রণববাবু। শনি মন্দিরের বাৎসরিক উৎসবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে পাওয়ার আবেগঘন মুহূর্তও উঠে এসেছে প্রতিবেশীদের কথায়। তাঁদের স্মৃতিতে ধরা আছে আরও অনেক মুহূর্তের ছবি। প্রবল বৃষ্টিতে জলমগ্ন এলাকা। প্রণববাবুকে কাঁধে করে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতির বাড়ির পাড়ার বাসিন্দা হওয়ার একটা আলাদা অনুভূতি অবশ্যই আছে। তবু প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন মামাবাবু হিসেবেই।
‘বাতায়ন’-এর বাড়িতে ৩৫ বছর ধরে রয়েছেন ছায়া নস্কর। প্রণববাবুর স্ত্রী তাঁকে ঢাকুরিয়ার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। রান্নাবান্না থেকে বাড়ির কাজ— সবটাই দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ছায়াদেবী। ‘দাদা’কে হারিয়ে শোকে পাথর তিনি। ছায়াদেবীর মেয়ে শ্যামলী ও ছেলে শিবুর জীবনের বড় সময় কেটেছে প্রণববাবুর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। তাঁদের কথায়, ‘মামাবাবু’ আর এখানে আসবেন না, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এ বাড়িতে প্রণববাবুর পূজার্চনা থেকে খাওয়া-দাওয়ার অনেক স্মৃতি উঠে এল তাঁদের কথায়। বসার ঘরের চেয়ারটা তখন সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিভিন্ন পরামর্শের জন্য কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রণববাবুর কাছে আসতেন, তা একনাগাড়ে বলে গেলেন ছায়াদেবী, শিবু-শ্যামলীরা। প্রণববাবুর বসার চেয়ারের উপর রয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। অন্য ঘরগুলিতেও রয়েছে তাঁর সঙ্গে রাজীব, ইন্দিরার ছবি। শোবার ঘরে প্রচুর বই। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশের সঙ্গে প্রণববাবুর একটি ছবিও ফ্রেমবন্দি সেখানে। একপাশে ঠাকুরের সিংহাসন। দুধ, গঙ্গাজল, চন্দন বাটা, তুলসি পাতা, বাতাসা, নৈবেদ্য থাকত পুজোর উপকরণে। সময় নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজার্চনা করতেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি।
কথাবার্তায় উঠে আসে প্রণববাবুর পছন্দের খাবারের তালিকাও। গরম জল থাকত ফ্লাক্সবন্দি। নারকেল দিয়ে মোচার ঘণ্ট, রসুন-কালোজিরে দিয়ে কলমি শাকভাজা, নিরামিষ স্যুপ, হালকা করে রান্না করা পাঁঠার মাংস, আর কাতলা মাছ ভাজার স্মৃতি এখন সঙ্গী ছায়াদেবী।