বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

ডলারে অটোগ্রাফ দেওয়া ভারতীয় যুবকই হয়ে উঠলেন সুপারহিট কম্পোজার

September 5, 2020 | 2 min read

১৯৫৮ সাল। সাধারণ পোশাক পরা ৩৫-৩৬ বয়সী যুবকটি যখন দোকানে ঢুকল, দোকানের  কর্মী ক্রিস্টিনা তেমন আমল দেননি। এ রকম অনেক মানুষই আসেন তাঁদের দোকানে, বেশির  ভাগই এটা-ওটা দেখেন, তার পর চলে যান। যে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র এই দোকানে রাখা আছে, তা বোঝার মতো মানুষ কমই আছেন এই পৃথিবীতে।

সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের এই দোকানটি তখন ইন্ডিয়ান মিউজিকের একমাত্র দোকান সারা আমেরিকায়। মালিক ডেভিড বার্নার্ড সেই সমস্ত জিনিস রাখেন যা দুনিয়ার ধ্রুপদী সংগীতের সমঝদাররাই একমাত্র বুঝবেন। সেখানে এই সমস্ত সাধারণ লোকেদের কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তাই এক রকম অনিচ্ছার সাথেই ওই যুবককে ‘‘এক্সকিউজ মি, স্যার, আপনাকে কী ভাবে  সাহায্য করতে পারি?’’ জিজ্ঞেস করলেন ক্রিস্টিনা। সেই যুবক সেতার দেখতে চাইলেন।   ক্রিস্টিনা ভাবলেন, এ নির্ঘাত শখের বাজনদার, কোথাও সেতারের শো দেখে তার মাথায় সেতার বাজানোর শখ চেপেছে। 

দোকানের সংগ্রহের সাধারণ সেতারগুলো দেখানো শুরু করতেই লোকটা নিজে থেকেই নানান সেতার নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল। কিছু ক্ষণ পর ক্রিস্টিনা বিরক্ত হয়ে গেলেন। প্রায় সব রকম সেতার দেখানোর পরও লোকটার যেন কিছুই পছন্দ হয় না। এ রকম একটা সাদামাটা লোক সেতারের বোঝেটা কি? এমন দারুণ দারুণ সেতারের কোনওটাই পছন্দ হচ্ছে না?     

হঠাৎ একেবারে ওপরের তাকের দিকে আঙুল দেখিয়ে যুবকটি বললেন, ‘‘ওই সেতারটা মনে হচ্ছে কাজে লাগতে পারে, বাজিয়ে দেখি একটু? যদি দেখান।’’ সেতারটা অত্যন্ত দামি, নামানোও  কঠিন, তা ছাড়া ওটা সাধারণের বাজানোর সেতার নয়, একমাত্র কোনও বিরাট মাপের সেতার-বিশারদ ওটা ঠিকঠাক বাজাতে পারেন। 

ক্রিস্টিনা গলায় একটু ঝাঁঝ মিশিয়েই বললেন, ‘‘ওটা সাধারণ সেতার নয়, নামানো যাবে না। তা ছাড়া ওটা বাজানোর অনুমতিও আপনি পাবেন না, কারণ ওটা ‘বস সেতার’। অত্যন্ত দামি, আর বাজানোও সহজ কাজ নয়। ও রকম একটা দামি আর জটিল সেতার নামী সেতারবাদকরা শুধুমাত্র বড় বড় অনুষ্ঠানেই বাজিয়ে থাকেন। আপনি বরং অন্যগুলোর মধ্যে থেকে একটা পছন্দ করুন।’’

কিন্তু যুবকটি নাছোড়বান্দা, সে ওই সেতারটাই দেখবে। এবং নিজে বাজিয়েই দেখবে। উপায় না দেখে ক্রিস্টিনা তাকে পাঠালেন মালিক ডেভিড বার্নার্ডের কাছে। এক প্রকার নিশ্চিত হয়েই যে ডেভিড তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করবেন।

যুবকের কথায় কী মনে হল কে জানে, ডেভিড সেতারটা নামিয়ে বাজানোর অনুমতি দিলেন তাকে। সেতারের তার টিউন করতে করতে যুবকটি বললেন, ‘‘আপনারা একে ‘বস সেতার’ বলেন, আমাদের দেশে একে ‘সুরবাহার সেতার’ বলা হয়।’’ তার পর চোখ বুজে শুরু করলেন সেতার বাজানো।

বাজনা যখন শেষ হল, তখন দোকানের ভিতরে-বাইরে ভিড় জমে গেছে। ডেভিড এগিয়ে এসে যুবকটির হাত ধরে বললেন, ‘‘অসামান্য, অভূতপূর্ব! এ রকম বাজনা আমি শুধু পণ্ডিত রবিশঙ্করের শো-তে শুনেছি। হলফ করে বলতে পারি, আপনি ওঁর চেয়ে কম প্রতিভাধর নন। কে আপনি? দয়া করে আপনার পরিচয় দিন, আর বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’’

যুবকটি বললেন, ‘‘এই সেতারটি আমি কিনব, আপনি শুধু বিলটুকু করে দিন।’’ দোকানের মালিক বললেন, কিনতে হবে না, আমি আপনাকে এই সেতারটা উপহার হিসেবে দিলাম।’’ ক্রিস্টিনা সেতারের সুর শুনে আবেগে কাঁদছিলেন, এগিয়ে এসে যুবকটির হাতে একটা ডলারের নোট গিয়ে বললেন, ‘‘আমি ভারতীয়দের একটু নিচু নজরে দেখতাম, গুরুত্ব দিতাম না, কিন্তু আপনার বাজনা যেন আমাকে চাবুক মারল। জানি না ভবিষ্যতে আমাদের দেখা হবে কি না, আমি এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে এই নোটে আপনার একটা অটোগ্রাফ দেন, আমি সারা জীবন এটা আমার সঙ্গে রাখতে চাই— এমন এক জন অসাধারণ প্রতিভার স্মৃতি হিসেবে।’’

যুবকটি সেতার নিয়ে ফিরলেন। সে বছরই, রাগ খাম্বাজের উপর তৈরি করলেন একটা গান, ব্যবহার করলেন সেই সুরবাহার সেতারটি। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন সেই গান: ‘না যেয়ো না, রজনী এখনও বাকি…’। সুপারহিট সেই গান পরের বছর তৈরি করলেন হিন্দিতেও।

সেদিনের সেই যুবকটি ছিলেন সলিল চৌধুরী।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#superhit composer, #Salil Chowdhury

আরো দেখুন