বিখ্যাত দিদির বোন, তবুও স্ট্রাগলই ছিল আশা ভোঁশলের জীবনের সত্য
লতা তখন পরিবারের দারিদ্র মেটানোর জীবন যুদ্ধে নেমেছেন, গান গাইছেন মারাঠি ছবিতে। ওই সময়টাতে ছোট বোন আশাও কিছু একটা করার জন্য তড়পাচ্ছিল। ১০ বছর বয়সে তাঁকেও দেখা গেল মারাঠি ছবিতে। মাঝা বাল ছবিতে তার রেকর্ড করা প্রথম গান ‘ চালা চালা নভ বালা’।
পাঁচ বছর পর (১৯৪৮) হনসরাজ বেহলের চুনারিয়া ছবির মাধ্যমে হিন্দি গানেও অভিষেক। গানের প্রথম কলি ‘সাওন আয়া’। কিন্তু বাস্তবে আশার জীবনে শ্রাবণ নয়, এলো বসন্ত। প্রেমের দোলা লাগল মনে। প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে তার চেয়ে ১৫ বছরের বড় গনপত রাও ভোঁশলেকে বিয়েই করে ফেললেন বাড়ি থেকে পালিয়ে। কিন্তু গনপত রাও বিয়ের পর ছবির নায়কের মতো আশার জীবনের সব মুশকিল আসান করে দেননি। বরং হয়েছেন আশাভঙ্গের কারণ।
গনপতকে বিয়ে করায় আশার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন লতা। চার বছরের ছোট যে বোনের জন্য তাঁর লেখাপড়া হলো না, সংসারের দুর্যোগের সময় সেই বোন কিনা স্বার্থপরের মতো নিজের সুখের ঠিকানা খুঁজতে গেল? এ সময়ে দিদির কাঁধে কাঁধ মেলানোটা তার কর্তব্য- এ কথাটা আশা ভাবলোই না!
বিয়েটাকে লতা দেখলেন আশার স্বার্থপরতা হিসেবে। এসব ভেবে অভিমানী লতা আর কথাই বলেন না আশার সঙ্গে। একসঙ্গে ডুয়েট গাইতে গিয়ে আশাকে যাতে দেখতে না হয় সে জন্য ডান হাতে গানের খাতা নিয়ে মুখ সরিয়ে রাখেন। সেই দিদি, এক সময় মায়ের মতো তাকে বুকে আগলে রেখেছে যে!
নিয়তি অবশ্য বেশিদিন দিদির কাছ থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। বয়সে অনেক বড় এবং খুব বেশি রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে গনপত রাওয়ের সঙ্গে একেবারেই বনিবনা হচ্ছিল না। বিয়ের পর পারিবারিক অনুশাসনের যাঁতাকলে পড়ে আশাজী বুঝলেন কম বয়সে পরিবার নির্বাচনেও বড় ভুল করে ফেলেছেন। নিজের আয়ের টাকা, নিজের টাকায় কেনা গয়নাগাটি সব ফেলে হেমন্ত আর বর্ষাকে নিয়ে এক বস্ত্রে চলে যান মায়ের কাছে। দিদি লতা মঙ্গেশকর তখন আর মুখ ফিরিয়ে রাখেননি।
লতার ছোট বোন হিসেবে পেশাগত জীবনে কোনো সুবিধা পাননি আশা। হিন্দি ছবির গানে তখন লতা, নূরজাহান, গীতা দত্তদের দাপট। সব ছবিতে তাঁরা গাওয়ার পর যেসব গান থাকতো সেগুলো দেয়া হতো। সোজা কথায় ‘বি’ বা ‘সি’ গ্রেডের গানগুলোই পেতেন আশাজী।
প্রথম বলার মতো ব্রেক পেতে পেতে কেটে গেল ১৪ বছর। ১৯৪৩ সালে ১০ বছর বয়সে গেয়েছিলেন প্রথম গান। তার ৯ বছর পর দিলীপ কুমার অভিনীত সাঙদিল ছবির একটি গান একটু পরিচিতি দিল। বিমল রায় পরিচালিত পরিনীতা (১৯৫৩) এবং রাজ কাপুর অভিনীত বুট পালিশ ছবিতে (মোহাম্মদ রফির সঙ্গে নানহে মুন্নে বাচ্চে) গেয়ে আরো কিছু শ্রোতার মন পেলেন। তবে দিলীপ কুমার-বৈজয়ন্তীমালার নয়া দওড় ছবিতে ‘মাঙ্গকে সাথ তুমহারা’ গানটি গেয়ে প্রথম সত্যিকারের শ্রোতাপ্রিয়তা পেলেন ১৯৫৭ সালে।
সেই থেকে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও একটা সময় পর্যন্ত ক্যাবারে নাচ, বিশেষত হেলেনের গান মানেই বোঝাতো আশা ভোঁসলেকে। ‘পিয়া তু আব তো আ যা’ (ছবি: ক্যারাভান), ‘ও হাসিনা জুলফো ওয়ালি’ (তিসরি মঞ্জিল) বা ‘ইয়ে মেরা দিল পেয়ারকা দিওয়ানা’-র (ডন) মতো তুমুল জনপ্রিয় গানগুলোর সঙ্গে ছবিতে কিন্তু নৃত্যপটিয়সী হেলেনই ঠোঁট মিলিয়েছেন।
আশাজীর গানে বৈচিত্র্য আসা বা ক্যারিয়ারের উত্থানের ব্যাপারটি ঘটেছে মূলতঃ তিনটি পর্বে। ১৯৫৭ সালে ওপি নায়ারের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘নয়া দওড়’ ছবির গানগুলো দিয়ে শুরু প্রথম পর্বের। এ ছবিতে সাহির লুধিয়ানভির কথায় মোহাম্মদ রফির সঙ্গে ‘মাঙকে সাথ তুমহারা’, ‘সাথী হাথ বাড়হানা’ আর ‘উড়ে যব যব জুলফে তেরি’ – এই তিনটি গান গেয়ে প্রথম বড় সাফল্য পেয়েছিলেন।
তারপর ওয়াক্ত, গুমরাহ, হামরাজ, আদমি অওর ইনসান, হাওড়া ব্রিজ, মেরে সনম, এক মুসাফির এক হাসিনা, তুমসা নেহি দেখা, কাশ্মির কি কলি এবং ধুন্দসহ বেশ কিছু ছবিতে আশাজীর কন্ঠের চমৎকার ব্যবহার করেছেন ওপি নায়ার। আশাজীর গাওয়া ‘আইয়ে মেহেরবান’, ‘ইয়ে হ্যায় রেশমি জুলফোকা আন্ধেরা’, ‘আয়ো হুজুর হামকো’, ‘যাইয়ে আপ কাহা যায়েঙ্গে’–এসব গান ওপি নায়ারের অমর সৃষ্টি।
ওই সময় আরো কিছু ব্যাপারও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে আশাজীর উত্থানে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে কথা বন্ধ থাকায় মোহাম্মদ রফি এ সময় বেশ কিছু গান গেয়েছেন তাঁর সঙ্গে। এছাড়া সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেননি লতা মঙ্গেশকর। এর সুবিধাও পেয়েছেন। নইলে কালা পানি, কালা বাজার, ইনসান জাগ উঠা, লাজবন্তি, সুজাতা এবং তিন দেবিয়া-র অসাধারণ কিছু গান একচেটিয়াভাবে গাওয়ার সুযোগ আশা পেতেন কিনা সন্দেহ।