তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – রবীন্দ্র-উত্তর পর্বের এক উজ্জ্বল কথাশিল্পী
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে উঠেছে সাবলীলভাবে। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তার একাধিক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়বস্তু। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি।
তার লেখায় বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু। সেখানে আরও আছে গ্রাম্যজীবনের ভাঙনের কথা, নগরজীবনের বিকাশের কথা।
মহান লেখকের জন্ম ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। তার বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা প্রভাবতী দেবী। তার পিতা বাড়িতে নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারত, তন্ত্রশাস্ত্র প্রভৃতি পাঠ করতেন। তিনি সে সব গ্রন্থ না পড়লেও কালীদাস থেকে শুরু করে বঙ্গিমচন্দ্র ও সমসাময়িক অন্য লেখকদের লেখা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তবে বাল্যকালে পিতাকে হারান তিনি।
তারাশঙ্কর তার মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। অন্য আর দশটি সাধারণ বাঙালি সন্তানের মতো তার বেড়ে ওঠা। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কালীপূজা হতো। তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। কিন্তু এই ধার্মিক পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা ঘটে— তারাশঙ্করের জন্মের আগে তার সহোদরের মৃত্যু হয়। তাই তাদের পরিবারে তারা মায়ের পূজা শুরু হওয়ার ঠিক দশ মাস পরে তারাশঙ্করের জন্ম। তারা মায়ের দয়ায় জাত বলেই তার নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর।
১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। ওই বছর তার প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ প্রকাশ হয়। ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হন। বাংলা কথাসাহিত্যের চিরস্মরণীয় লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্রের তিনি যথাযথ উত্তরসূরি। বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন তিনি।
একদিকে গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এই নীরব পরিবর্তন তার রচনায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। তার রচনার বিষয় এবং রচনার চরিত্রগুলোর দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হলো গ্রাম্যজীবনভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী, আর দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। একটা ভাগ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পর্যন্ত। আর একটা ভাগ ‘মন্বন্তর’ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত।
১৯৫৫ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে তাসখন্দে এশীয় লেখক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সফর করেন মস্কোও। অর্থের প্রয়োজনে শেষদিকে কিছুদিন দৈনিক সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন। শেষ বয়সে কিছু ছবিও এঁকেছিলেন। তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’, পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেয় শরত্স্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতিপদক, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেহত্যাগ করেন।