মমতার উদ্যোগে উদ্ধার বালুচরির অবলুপ্ত ডিজাইন
এ যেন মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের অনুসন্ধান। শতশত বছরের অবলুপ্ত সম্পদকে রেশমের সুতোয় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। না, গল্প নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া বাংলার বালুচরি শাড়ির ন’টি ডিজাইন পুনরুদ্ধার করল তন্তুজ। যার সুক্ষ্ম নকশায় ফুটে উঠেছে বাংলার প্রাচীন দিনলিপি। নবাবি আমলের বনেদিয়ানাও। পুজোর মুখে বিদেশের বাজারে এই ‘মূল্যবান’ বালুচরির চাহিদাও বাড়ছে। ইতিমধ্যেই কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ একাধিক দেশে পাড়িও দিয়েছে এই শাড়ি। সরকারের দাবি, করোনা পরিস্থিতি মিটলে চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে, বাংলার শিল্পীরাও উপকৃত হবেন।
কথিত আছে, ১৭০৪ সালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের হাত ধরে সামনে এসেছিল ঐতিহ্যশালী বালুচরি শাড়ি। ঢাকা থেকে তিনি মুর্শিদাবাদের বালুচরে উৎপাদন শুরু করিয়েছিলেন। সেই সূচনা। সেখান থেকেই পরে স্থানান্তর হয় মল্লরাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর শহরে। বাংলার বালুচরি গোটা দেশেই সুনাম কুড়িয়েছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুবার পাড়ি দিয়েছে বিদেশের মাটিতেও। কিন্তু, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বালুচরির একাধিক ডিজাইন অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বহু প্রবীণ শিল্পীরও মৃত্যু হয়েছে। ফলে, পুরনো নকশাগুলি ক্রমশ হারাতে বসেছিল।
তন্তুজ সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বালুচরির অবলুপ্ত ডিজাইনগুলি পুনরুদ্ধার করার ভার দিয়েছিলেন তন্তুজকে। তাঁর নির্দেশে ২০১৬ সাল থেকে এই কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু, কোথাও মিলবে সেই পুরনো ডিজাইন? বিভিন্ন শিল্পীদের বাড়ি এবং রাজ্যের একাধিক মিউজিয়ামে খোঁজ শুরু হয়। সেখানেই ওই হারিয়ে যাওয়া ডিজাইনের খোঁজ মেলে। তারপর তন্তুজের ডিজাইনাররা প্রতিটি ডিজাইনের ছবি তুলে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন। কারণ, সেই সময় যেভাবে শাড়ি বোনা হয়েছিল, সেই পদ্ধতি এখন নেই। শেষমেশ প্রতিটি ডিজাইনকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেখানে একাধিক নবাবি নকশা রয়েছে। কোথাও ঘোড়ার পিঠে চড়ে নবাব ভ্রমণে চলেছেন। মাথার উপর ছত্রি। সামনে পিছনে সারিবদ্ধ সৈন্যদল। কোথাও আবার সিংহাসনে বসে পাইপ সেবন করছেন। কোথাও কামান দাগছেন সৈন্যরা। এছাড়াও তৎকালীন সময়ের নানা জীবনযাত্রার ছবি ফুটে উঠেছে। তন্তুজের ডিজাইনার অনিন্দিতা নাথ পুরকাইত বলেন, সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর মোট ন’টি অবলপ্ত ডিজাইন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই এই কাজ সম্ভব হয়েছে।
দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই বালুচরি শাড়ির দাম অনেকটাই বেশি। সাধারণ বালুচরি ছয় থেকে সাত হাজার টাকায় শুরু হয়। কিন্তু, এই শাড়ির দাম শুরু ২০ হাজার টাকা থেকে। প্রায় এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যের শাড়ি রয়েছে। কিছুদিন আগেই পার্কস্ট্রিটের প্রজেক্ট বালুচরি হাব থেকে ৮৭ হাজার টাকায় একটি বালুচরি কানাডায় বিক্রি হয়েছে। আমেরিকার এক ক্রেতা ৩৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি শাড়ি কিনেছেন। এছাড়াও মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াতেও বিক্রি হয়েছে।
তন্তুজের চেয়ারম্যান তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, বালুচরি বাংলার সম্পদ। সেই শাড়ির শতশত বছরের প্রাচীন ডিজাইনগুলি অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে সেগুলি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ফলে, বাংলার হারানো ইতিহাস আবার নতুন করে জায়গা পেল।