বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের কাজ বহুধা বিস্তৃত 

September 23, 2020 | 3 min read

নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি শব্দবন্ধগুলি প্রায়শই সামনে আসে৷ ঘটা করে, অনেক কর্মসূচি এবং শপথ নিয়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস৷ ৮ই মার্চ প্রতি বছরই আসে এবং চলে যায়৷ শ্রদ্ধা এবং সম্মান জ্ঞাপনের জন্য শুধু একটি দিন নয়, তা হোক বছরের প্রত্যেকটা দিনই৷ 

শুধু আয়োজনে আড়ম্বরতা নয়, অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করে আরও অসীমা চট্টোপাধ্যায় গড়ে তোলার ব্রত নিলে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সমানাধিকার, সম্মান প্রদর্শন সবই বাস্তবায়িত হবে৷ 

১৯১৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর অসীমা চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন৷ বাবা চিকিত্সক ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় কলকাতায় থাকলেও তাঁরা আদতে ছিলেন হুগলির হরিপালের বাসিন্দা৷ স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে স্নাতক অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব রসায়ন বিষয়ে ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন৷ 

রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে কলেজে পড়বে? 

এই বিষয়ে বাবা মাকে বাদ দিয়ে পরিবারের অন্যান্য বড়দের ঘোর আপত্তি ছিল৷ কিন্তু তাঁর মা কমলাদেবী কোনও আপত্তিই মানেননি মেয়েকে ছেলেদের সাথে কলেজে পড়াতে৷ মেয়েকে সব দিক থেকে পারদর্শী করে গড়ে তুলতে কোনও দিকে খামতি রাখেননি বাবা মা৷ প্রাচীন সাহিত্য পড়ে জ্ঞান লাভের জন্য সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন মেয়েকে৷ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে ১৪ বছর তালিম নিয়েছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়৷

১৯৪০ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান ছিলেন তিনিই৷ গবেষণা করেছিলেন উদ্ভিদ রসায়ন এবং কৃত্রিম জৈব রসায়ন বিষয়ে৷ তিনিই প্রথম মহিলা যিনি রসায়ন শাস্ত্রে কোনও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি পান ১৯৪৪ সালে৷ ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সাম্মানিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৪৭এ তিনি প্রথমবার আমেরিকা যান গবেষণার কাজে৷ 

এই সময় তিনি দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন গভর্নেস সহ তাঁর এগারো মাসের কন্যা জুলিকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় যেতে৷ সেখানেই তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সংস্পর্শে আসেন৷ এ দেশেও আমৃত্যু জড়িয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে৷ তিনি গবেষণা করেছেন ইউনির্ভাসিটি অব উইসকন্সিন, ম্যাডিসন ও ক্যালটেক থেকে৷ দেশে ফিরে ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন৷ ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত ছিলেন খয়রা প্রফেসর হিসেবে৷

তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন তাঁর ভিঙ্কা অ্যালকলয়েডের (নয়নতারা ) ওপর গবেষণার জন্য, যেটি কর্কট(ক্যান্সার) রোগের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়৷ মৃগী রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন শুশুনি শাক থেকে এবং ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন ছাতিম, কুটকি, চিরতা প্রভৃতি থেকে৷

ক্যান্সার নিরাময় বিষয়ে বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং একসময় সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছিলেন৷ নিয়ম করে ভিটামিন সি খাবার খুব সহজ পরামর্শ ছিল তাঁর৷ বিতর্কও হয়েছিল এ বিষয়ে৷ ১৯৭৯ সালে তিনি ‘ক্যান্সার অ্যান্ড ভিটামিন সি ’ শীর্ষক একটি বই লিখেছিলেন৷ ক্যান্সার নিরাময় বিষয়ে কাজ করেছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়ও৷ ১৯৫৩ সালের ৭ই জুলাই তিনি চিঠি লিখে সর্পগন্ধার অ্যালকালয়েড বা উপক্ষারের এক্স-রে বিশ্লেষণগত ফলাফল বিষয়ে পরামর্শ চান পাওলিংএর কাছে৷ শিক্ষা এবং কর্মসূত্রে পেয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ ভারতসেরা বিজ্ঞানীদের৷ 

ভারতীয় বনৌষধি নিয়ে গবেষণা তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘ভারতীয় বনৌষধি’ শীর্ষক ছ’টি গ্রন্থের পরিমার্জন ও সম্পাদনা করেন তিনি৷ অসীমা চট্টোপাধ্যায় সত্যেশচন্দ্র পাকড়াশির সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেন ‘দ্য ট্রিটিজ অব ইন্ডিয়ান মেডিসিন্যাল প্ল্যান্টস ’ শীর্ষক গ্রন্থ৷ তাঁরই প্রচেষ্টায় সল্টলেকে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদ গবেষণা কেন্দ্র৷ সব কাজে উত্সাহ পেয়েছিলেন বাবা -স্বামীর কাছ থেকে, পাশে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত চিকিত্সক ভাই সরসীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে৷

নিজস্ব ক্ষেত্রে শান্তিস্বরূপ ভাটনগর সহ বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি৷ ১৯৭৫ সালে পান পদ্মভূষণ৷ ওই বছরই তিনি প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন৷ সাম্মানিক ডিএসসি উপাধি পান বর্ধমান, কল্যাণী, বিদ্যাসাগর এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে৷ ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য৷ কাছের মানুষদের তিনি বলতেন, ‘যতদিন বাঁচি ততদিন যেন শুধু কাজ করেই যাই৷’ বাস্তবে তিনি আমৃত্যু কাজই করে গেছেন মানুষের কল্যাণে৷ ৮৯ বছর বয়সে ২২ নভেম্বর ২০০৬ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Asima Chatterjee

আরো দেখুন