টিআরপি নেই, বন্ধ হচ্ছে কাদম্বিনী
টিআরপি পড়ে যাওয়াতেই ‘কাদম্বিনী’ –র দৈনিক শো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘জি’। ৫ অক্টোবর সিরিয়ালটির শেষ এপিসোড দেখানো হবে বলে সেটির সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ৬ অক্টোবর থেকে কাদম্বিনীর জীবন নিয়ে একটিই মাত্র সিরিয়াল দেখতে পাবেন বাঙালি দর্শক। সেটি স্টার জলসার ‘প্রথমা কাদম্বিনী’, যা ১০০ পেরল! রেটিংয়েও দুই ধারাবাহিকের অবস্থান লক্ষ্য করার মতোই। প্রথমটি রেটিংয়ে এই সপ্তাহেও চারের ঘরে। দ্বিতীয়টি দীর্ঘ দিন ৪-এর ঘরে থাকার পর চলতি সপ্তাহে ৫.৩।
কেন চলতি বছরেরে ৬ জুলাই শুরু-হওয়া ‘কাদম্বিনী’ টিআরপি পেল না, তা নিয়ে টলি সিরিয়ালের সঙ্গে জড়িত বিভিন্নজনের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে সিংহভাগের বক্তব্য, চালু সিরিয়ালের মডেলে গল্প না এগনোয় দর্শকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ, সফল সিরিয়ালে একজন নায়ক, তার স্ত্রী এবং প্রেমিকাকে নিয়ে ত্রিকোণ প্রেম কিম্বা সাংসারিক কূটকচালি অথবা যৌথ পরিবারের অতি নাটকীয়তা থাকে। ‘কাদম্বিনী’ সিরিয়ালে সেসব কিছু পাননি দর্শক। এমন কথাও শোনা গিয়েছে, যাঁদের বাড়িতে টিএরপি মাপার যন্ত্র বসানো রয়েছে, তাঁরাও ‘কাদম্বিনী’-র চেয়ে ‘কৃষ্ণকলি’, ‘মোহর’, ‘শ্রীময়ী’ ইত্যাদি সিরিয়াল নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। অন্তত টিআরপি-র হিসাব তেমনই বলছে। কাকতালীয় হলেও প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছরদশেক আগে একটি সিরিয়াল শুরু হয়েছিল গ্রাম থেকে আসা এক সাধারণ মেয়ের বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে লড়াই করে চিকিৎসক হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে। কিন্তু দর্শক না পাওয়ায় ১০টি এপিসোডের পরেই বন্ধ করে দিতে হয় সেই ধারাবাহিকটি।
প্রসঙ্গত, জি বাংলার নিজস্ব প্রযোজনা ‘রাণী রাসমণি’-র ও মান পড়তির দিকে। কিন্তু সেটি এখনও বন্ধ করা হয়নি। ওয়াকিবহালদের অনেকেরই দাবি, নিজস্ব প্রযোজনা আর বাইরের প্রযোজকের তৈরি সিরিয়ালের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ‘রাসমণি’ এক বছরে গতানুগতিক ছন্দে চলে এসেছে। তাকে নিয়ে নতুন করে আর ভাবার কিছু নেই।
‘কাদম্বিনী’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতত চ্যানেল এবং নায়ক-নায়িকার মুখে কুলুপ। বুধবার রাতেও আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কেউই মুখ খুলতে রাজি নন। তবে ‘কাদম্বিনী’-র সঙ্গে যে সিরিয়ালের টিআরপি নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, সেই ‘প্রথমা কাদম্বিনী’-র প্রযোজক অরবিন্দ দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘‘যে কোনও শো বন্ধ হওয়াই খারাপ। সত্যিই খারাপ লাগছে। তবে লোকসান হলে এ ভাবেই সরে যেতে হয়। এটাই নিয়ম। চ্যানেলের নিজস্ব প্রোগ্রাম বা বাইরের প্রযোজনা— সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ম খাটে। এ নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই।’’
ঘটনাচক্রে, কাদম্বিনীদেবীর পরিবারের তরফে ওই সিরিয়ালটি নিয়ে ‘জি’ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। যাতে বলা হয়েছিল, কাদম্বিনী এবং তাঁর স্বামী দ্বারকানাথের জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। কাদম্বিনীর পরিবারের তরফে তাঁর প্রপৌত্র রজত গঙ্গোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমি আনন্দবাজার ডিজিটাল থেকেই খবরটা জানতে পেরেছি। টিআরপি কমে যাওয়ার কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। দর্শক দেখছেন না, সেটা ঠিক নয়। অন্য একটা চ্যানেলে তো এই একই বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক হচ্ছে। আমি জানি, সেটা দর্শক উপভোগ করছেন। কিন্তু এই চ্যানেলে কাদম্বিনীদেবী এবং দ্বারকানাথের জীবন সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেখানো হচ্ছিল। সে সব বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট চ্যানেলকে চিঠিও লিখেছিলাম। সেখানেই বলেছিলাম, ‘কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’ থেকে আমার এবং আমার স্ত্রী-র নাম সরিয়ে দিতে।’’
‘কাদম্বিনী’ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর প্রযোজক রানা সরকার বুধবার রাতে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাত্র ৭৫টি এপিসোড প্রচারিত হওয়ার পরই এই অবস্থা কেন? সিরিয়ালটি জি বাংলার নিজস্ব প্রযোজনা। তাই ওঁরা বুঝতে পারলেন প্রযোজনার কত ধানে কত চাল।’
প্রসঙ্গত, স্টার জলসায় কাদম্বিনীর কাহিনি দেখানো হয় সন্ধ্যা ৬টায়। জি-তে রাত সাড়ে ৮টায়। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন এবং হিন্দু সমাজের দাদাঠাকুরদের অগ্রাহ্য করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। সেই সময়ের সমাজে অবিশ্বাস্য ঘটনা! তখন ডাক্তার বলতে কোট-প্যান্ট পরিহিত, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো ভারিক্কি পুরুষকেই কল্পনা করা হত। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কথা দূর অস্ত! ডাক্তারি পড়তে চাওয়া মেয়েটিকে পেরতে হয়েছিল একের পর এক বাধার পাহাড়। ডাক্তার সমাজেও ব্যাপারটা খুব আনন্দের কিছু ছিল না। পুরুষশাসিত চিকিৎসক মহলে নারীর অনুপ্রবেশকে সুবিধের চোখে দেখেনি সমকালীন ভিক্টোরীয় নৈতিকতায় ডুবে থাকা পশ্চিমি ও পশ্চিমি ভাবাপন্ন বাঙালি সমাজও। কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়তে চাওয়াকে খোলা মনে স্বাগত জানাতে পারেননি বেশির ভাগ পুরুষই।
কিন্তু কাদম্বিনীর জেদ আর তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উৎসাহের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় প্রতিষ্ঠান। মেডিক্যাল কলেজে পুরুষদের সঙ্গে পড়ার অধিকার পান কাদম্বিনী। শুধু কলকাতা থেকে ডাক্তারি শিক্ষা নয়, তিনি অনুভব করেছিলেন, এ দেশের পুরুষ-শাসিত ডাক্তার সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিতে হলে দরকার বিলিতি স্বীকৃতিও। খাস ইংল্যান্ড থেকে তিনটি মেডিক্যাল ডিপ্লোমা নিয়ে দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী।