ইতিহাস কি বলছে মনমোহন সিং সম্পর্কে?
তিনিই ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের স্থপতি, ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে যোগ্য প্রধানমন্ত্রীর তকমা হয়তো জোটেনি, তবে তাঁর বহুমুখী নেতৃত্বেই ভারতের অর্থনীতি দিশা পেয়েছিল। তাঁর অদম্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ আমরা বার বার দেখতে পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীত্বের শেষ বছরে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁর সমালোচকদের থেকে ইতিহাস তাঁকে অনেক বেশি সদয়ভাবে বিচার করবে। প্রকৃতপক্ষেই, ইতিহাস বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং- কে বিচার করবে দেশের অর্থনীতির সংস্কারের জনক হিসেবেই।
১৯৭০ এর দশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদের জন্যে প্রথম পছন্দ ছিলেন তিনি। ফলত খুব অল্প সময়েই তিনি পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান হয়ে যান এবং পরবর্তীকালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হন।
তিনিই ভারতের আপদকালীন অর্থনৈতিক সংস্কারের পথপ্রদর্শক। দেশকে এক নতুন পথে পরিচালিত করেন। ১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনীতি ভয়ঙ্কর ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উত্পাদন খাতে নুন্যতম অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়। কর্মসংস্থানের হাল ভীষন খারাপ হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ভারতের অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কারণ রাজস্ব ঘাটতির কারণে দেশের জিডিপি ৮.৫ শতাংশ কমে যায়।
সহজভাবে বললে দেশ সেই সময় একটি বিশাল অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয় এবং যে কোনও অর্থনীতিবিদের পক্ষেই দেশের অর্থনীতির স্থিতি ফিরিয়ে আনা ছিল অসম্ভব। আর তখনই এই দায়িত্ব নেমে আসে ডঃ মনমোহন সিংয়ের কাঁধে।
তিনিই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন ভারতীয় অর্থনীতি এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে এবং তা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী খুশি মনে সম্মত হয়েছিলেন।
ডঃ সিং তখন উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন- এর নীতি গ্রহণ করেন এবং বিশ্বের অর্থনীতির সাথে দেশের অর্থনীতির একীকরণ শুরু করেন। তিনি যে পদক্ষেপগুলি সেদিন গ্রহণ করেছিলেন সেগুলি হল পারমিট রাজ নির্মূলকরণ, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, উচ্চ আমদানি শুল্কের হ্রাস, যা বিশ্বের কাছে দেশকে উন্মুক্ত করে দেয়।
সমাজতান্ত্রিক থেকে আরও বেশি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ভারতকে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনিই। সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ করেন এবং বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) পথ পরিস্কার করেন।
এই পদক্ষেপগুলি শুধু যে ভারতের অর্থনীতির উন্নতি করেছিল তাই না, বিশ্বায়নেরও প্রচার করেছিল। ডঃ সিংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি এখন ভারতীয় অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আর এই অর্থনীতির সংস্কারের কারণেই যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে কংগ্রেস তাঁর নাম প্রস্তাব করে তখন সারা দেশ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিল। কোন রাজনৈতিক পটভূমি না থাকা এই মানুষটি, তাঁর অগাধ জ্ঞান এবং দূরদর্শিতার জন্যে , ২০০৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।
২০০৪ থেকে ২০১৪ অবধি তিনি দেশ শাসন করেন। তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যার শাসনকালে আট বছর ধরে দেশের জিডিপির স্থায়ী বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ। চীন ছাড়া অন্য কোনও দেশ অর্থনীতি এই ধরণের বৃদ্ধির হারকে ছুঁতে পারেনি।
২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময়, তার কঠোর নীতিগুলির কারণে ভারতীয় অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল এবং কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তিনি অনেক যুগান্তকারী, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেগুলি হল নরেগা এবং আরটিআই।
নরেগা সমাজের দরিদ্রতম অংশকে ন্যূনতম মজুরির গ্যারান্টি দিয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালেই আরটিআই (তথ্য অধিকার আইন, ২০০৫) আইন পাশ হয়, যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তথ্য পাওয়ার এক বিতর্কিত এবং শক্তিশালী হাতিয়ার।
এই অল্প কথার, উচ্চ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষটিই, দেশের অর্থনীতিকে দেবদূতের মতো রক্ষা করেন।